মধুমিতা সিনেমা হলে বুক কাঁপানো ডলবি সারাউন্ড সাউন্ড, বিশাল স্ক্রিনে ঝকঝকে গডজিলা সিনেমা দেখার কথা হয়তো অনেকের মনে থাকবে। নব্বই দশকের শেষ দিকের দর্শকদের জন্য এটি একটি অভিজ্ঞতাই বটে। তখনো ড্রয়িং রুমগুলোতে ৫:১ অথবা ৭:১ হোম সিনেমা সাউন্ড সিস্টেম ছিল না কিংবা ছিল না বড় বড় এলসিডি স্ক্রিন। সাইফাই মনস্টার জঁরার এই সিনেমা পুরো বিশ্বকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বাজেট ছিল ১২৫ মিলিয়ন ডলার আর বক্স অফিস কালেকশনে এসেছিল ৩৭৯ মিলিয়ন ডলার। তখনো আইএমডিবি আর রটেন টোমাটোর রেটিং দেখে সিনেমা বাছাইয়ের লাক্সারিও আমাদের ছিল না। একুশ ইঞ্চি টেলিভিশনে ভিসিপি বা ভিসিআরে ভিডিও ক্যাসেট চালানোই বিরাট প্রযুক্তি ছিল। আর সেটিও ছিল অধিকাংশের আয়ত্তের বাইরে। তাই তখনো সিনেমা হলই ভরসা।
আমাদের দৃশ্য আর শব্দের জগৎ উপচে পড়েছিল নিউ ইয়র্ক শহরের ধ্বংসলীলা আর গডজিলার হুঙ্কারে। পরে গডজিলা নিয়ে কার্টুনও প্রচারিত হতো বিটিভিতে। তখনো আমরা অনেকেই জানতাম না যে গডজিলা; আসলে গজিরা আর এর মূল উৎপত্তি জাপানে। আমাদের জানাশোনার জগৎ যে অনেকটাই হলিউড নির্মিত এবং আমেরিকান প্রোপাগান্ডায় ভরপুর সেসব বুঝতে আমাদের সময় লেগেছে অনেক। এরপর পদ্মায় অনেক ঘোলা জল গড়িয়েছে, সেতুও তৈরি হয়েছে। জাপানি অ্যানিমেশন আর মাঙ্গার বিভিন্ন চরিত্রে নিজেদের খুঁজে পেয়েছেন এদেশের অনেক কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী। এমনকি কমিক কনভেনশনও আয়োজিত হয়ে আসছে কয়েক বছর ধরে, এই ঢাকাতেই। আরও একটি ঘটনা ঘটেছে গত এক দশকে। সেটি হলো মার্ভেলের সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সে দর্শকদের বুঁদ হয়ে থাকা। এন্ড গেইম, থর, আয়রন ম্যান-এর ফ্যাটিগ এখনো কাটেনি অনেকের। আমার প্রিয় চিত্রপরিচালক মার্টিন স্করসেসি এই ঘটনাকে বলেছেন সিনেমার মৃত্যু; শুধু দৃশ্য আর শব্দের স্পেক্টাকলে মুগ্ধ, বুঁদ হয়ে থাকা। প্রথম হলিউডি গডজিলা সিনেমার পর একে একে বেরিয়ে গেছে অনেকগুলো ফ্র্যাঞ্চাইজি সিনেমা। এরই মধ্যে জাপানে নির্মিত ‘গজিরা মাইনাস ওয়ান’ দেশটিতে রিলিজ পায় ৩ নভেম্বর ২০২৩। এরপর ছড়িয়ে পরে বিশ্ব জুড়ে। ডিরেক্টর তাকাশি ইয়ামাজাকির কাজটি বিপুল প্রশংসিত হয়, আইএমডিবি রেটিং ৮/১০; রটেন টোমাটো ৯৮% আর বক্স অফিস কালেকশনও মন্দ নয়; ১১৫.৮ মিলিয়ন।
ওশিন টিভি সিরিজটির কথা মনে পড়ে আপনাদের? বিটিভি-তে বহু বছর ধরে চলছে সিরিজটি। জাপানের খুব দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারে জন্ম নেওয়া একটি মেয়ের গল্প, যে কঠোর পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অবশেষে কষ্ট এবং প্রতিকূলতা জয় করে। কিংবা পাঠ্যপুস্তকে গোলাপি বা ছাই নিউজপ্রিন্টের পাতায় হিরোশিমার সেই বিল্ডিংটার কথা? যেটি ‘লিটল বয়’-এর বিস্ফোরণের পরও কোনোমতে টিকে গিয়েছিল। ‘লিটল বয়’ ছিল পরমাণু বোমা, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট, জাপানের হিরোশিমায় বিস্ফোরণে ব্যবহৃত হয়েছিল, এটিই যুদ্ধে ব্যবহৃত প্রথম পরমাণু বোমা।
জীবনে অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, ২০১৪ সালে আমি মনবুকাগাকুশো (মেক্সট বলে অধিক পরিচিত) স্কলারশিপে নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি করতে রওনা করি জাপানের উদ্দেশ্যে এবং সেটি হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়েই। ফলে পূর্বে বর্ণিত জাপানি অভিজ্ঞতা ছাড়াও জাপান সূর্যোদয়ের দেশ, জাপানিজ মানুষরা কঠোর পরিশ্রমী ও খুব শান্তিপ্রিয় কিংবা আরেকটি বিখ্যাত সিনেমা জাপানিজ ওয়াইফ; আর কিছু ভাঙাচোরা জাপানি ভাষা; এসবের বাইরে আমার জাপান-গমন প্রস্তুতি এর বেশি আর বিস্তৃত ছিল না। তবে আরেকটি অদ্ভুত ঘটনাও ঘটেছিল; যা পরে হিসাব করে মেলাতে পারি। ভ্রমণ এবং জ্ঞান অন্বেষণে যে দুটি দেশের সঙ্গে আমার সখ্য বেশ গড়ে উঠেছে- উভয়ই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত শক্তি। এক জাপান, অপরটি জার্মানি। একবিংশ শতককে বুঝতে আপনার অতি অবশ্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে বোঝা লাগবে। আর একটি বিষয়; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং অভিজ্ঞতাহীন আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার গুণগত তফাৎ পরিষ্কার। যেমনটা কলোনিয়াল রাষ্ট্র ও কলোনাইজড রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে।
হিরোশিমাতে থাকার কারণেই কি না জানি না কিংবা অ্যাটমিক বোম ডোম (সেই টিকে থাকা দালান) বা পিস মেমোরিয়াল পার্কে বহুবার যাতায়াতের কারণেই কি না, আমার তীব্র আগ্রহ তৈরি হয় গডজিলা নিয়ে। যুদ্ধের ঠিক আগের কিংবা পরের সিনেমার সঙ্গে রাষ্ট্রের নিবিড় সম্পর্ক থাকে। জহির রায়হানের একটি ছবির কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে পড়ছে। এসব ছাড়া যুদ্ধকালীন প্রোপাগান্ডা তো আছেই। রাষ্ট্রের চেহারা আর ক্ষমতার সঙ্গে সিনেমার সম্পর্কের ধরনও পাল্টাতে থাকে। আবার স্থানীয়, রিজিওনাল এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক অর্থনীতির সঙ্গে এর সম্পর্ক গভীর। জাপানে অনেকে আগে থেকে গজিরা সিনেমা তৈরি হতে থাকলেও তা গ্লোবাল মার্কেট পায়নি। তাই অনেকদিন পরে বহু হলিউডি গডজিলা সিনেমার ভিড়ে একটি জাপানে নির্মিত গডজিলা (গজিরা) সিনেমা হিট হওয়াটি ঘটনাই বটে। ছবিটি ক্রিটিক্যাল এপ্রিসিয়েশনও পেল; তবে নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে সেটিও বক্স অফিস কালেকশনে হলিউডের ধারেকাছেও নেই। তাহলে মনে রাখতে হবে যে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে জাপান; হলিউড এবং বলিউডের চেয়ে বেশ ছোট।
আরও বহুবারের মতো একদিন আমি হিরোশিমার পিস মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের ভেতরে গিয়েছিলাম। তাকিয়ে থেকেছি প্রদর্শিত একটি পাথরের দিকে, মনে হচ্ছিল পাথরে একটি ছায়া। অনেকক্ষণ তাকিয়েও বুঝতে পারিনি। মিউজিয়ামের ভেতরে নানান কিছু দেখে আবার যখন গিয়েছি তখন বুঝতে পেরেছিলাম বিষয়টি। পাথরের ছায়াটি আসলে একজন জীবন্ত মানুষের ছাপ। অ্যাটমিক বোমার প্রথম আঘাতেই যিনি পাথরের দেয়ালে ছাপচিত্র হয়ে গিয়েছেন। সিনেমাও তো তেমনি চলমান ছাপচিত্রই বটে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে গডজিলা/গজিরা আসলে কী বা কে? আমি মনে করি পোস্ট-ওয়ার জাপানে গজিরা হলো আধুনিক পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতীক। একটি জাতিকে সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করে দেওয়ার জ্বলজ্বলে দগদগে স্মৃতি। গজিরা সেই আদিপাপ। যার নিজের কোনো পাপ নেই, কারণ এই মহাশক্তি মানুষই তৈরি করেছে তার লোভ আর আগ্রাসনের কারণে। তাই নিয়তি এটিই যে গজিরা বারবার উঠে আসবে সমুদ্র থেকে আর ধ্বংস করবে। ডোনা হারাওয়ের বিশ্লেষণেও সেটির প্রতিফলন দেখতে পাই। জোসেফ ওয়েলস ব্যাখ্যা করেন এভাবে, “ইশিরো হোন্ডার মূল সিনেমা ‘গোজিরা’ (১৯৫৪) একটি পারমাণবিক মিউটেশন, যেন একটি প্রায় দৈবশাস্ত্রের সৃষ্টি, যা প্রশান্ত মহাসাগরের তলায় অবস্থিত। মানুষের পারমাণবিক পরীক্ষার ফলে নিরিহ এক প্রজাতি পরিণত হয় গজিরাতে।” যা মানুষের সৃষ্টি যদিও তা দৈবিক মনে হয়।
মানুষের সৃষ্ট অথচ দৈবিক এই শক্তি কি তাহলে জাপানি মানুষের ধর্মবোধের আদি উপাখ্যানের সঙ্গে জড়িত? এই গজিরাকে মানে হলিউডি নয় জাপানি গজিরাকে কিন্তু মানবিকীকরণ করা হয়নি। মানে মানুষের দোষগুণ যুক্তি দিয়ে বোঝানো হয়নি। এই অমোঘ শক্তিকে এবং তার ধ্বংসকে মানবিক যুক্তি-কারণ দেখিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। গজিরা মাইনাস ওয়ান কিন্তু গজিরার গল্প যতটা না করেছে তারও বেশি করেছে মানুষের গল্পের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে, যখন মোটামুটি নিশ্চিত যে জাপান হেরে যাচ্ছে তখন এক কামিকাজি (সুইসাইডাল) পাইলট আশ্রয় নেয় এক দ্বীপে। প্লেন মেরামত করতে গিয়ে মেকানিক বুঝতে পারে যে এই পাইলট আসলে যুদ্ধ থেকে পালিয়ে এসেছে; বাঁচতে চেয়েছে। সে সময়ই সেখানে আক্রমণ করে গজিরা এবং সেই পাইলটের বীরত্বের/আত্মাহুতির খামতিতে মারা পড়ে সেই দ্বীপের বাকি সৈনিকরা। সবাই অবশ্য মারা পড়ে না। এখানে আমরা দেখতে পাব জাপানি জাতীয়তাবাদ আর বীরত্বের গাথা। এমনকি লজ্জার গাথাও।
পোস্ট-ওয়ার জাপানের পরাজিত পরাশক্তি হিসেবে উঠে দাঁড়ানোর কঠোর স্ট্রাগলও এই গল্পের একটি মূল অংশ। আমার আবারও মনে পড়ে হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্কের কোনায় লুকিয়ে থাকা একটি ভাস্কর্যের কথা। যেটি নিবেদিত সেই প্রজন্মের শিশুদের উদ্দেশ্যে যারা তাদের শৈশব, শিক্ষা সবকিছু বিনিয়োগ করেছে রাষ্ট্রের পুনর্গঠনে। প্রশ্ন ওঠে কোন যুদ্ধ আসলে বড়? গজিরা কি সেই যুদ্ধের প্রতীক?
১৯৯৮ থেকে বর্তমান পর্যন্ত যতগুলো হলিউডি গডজিলা নির্মাণ হয়েছে খেয়াল করে দেখবেন সেখানে গল্প খুব হালকা। আসলে সিনেমা বানানোর মতো গল্প তো নয়ই। বরং একাধিক মনস্টারের মধ্যকার মারামারি দৃশ্য আর শব্দের মোহময়তা তৈরিই মূল উদ্দেশ্য। যদিও গজিরার ভেতরের গল্প হলো শত্রুর (আমেরিকার) কাছে পরাজয় এবং পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে বসবাস। মনে রাখবেন এখনো জাপানে অনেক আমেরিকান সামরিক বেস রয়েছে। তাহলে গজিরা কি আমেরিকা? আবারও জোসেফ ওয়েসিসের কাছে ঋণ করতে হয়। তিনি ফ্রয়েডের শেষের দিককার তত্ত্বকে ব্যবহার করে বলতে চেয়েছেন যে ‘কাম/লাইফ’ বা প্রাণের ইনসটিংট (ইরোস) হলো সেই তাড়না যা অর্গানিজমগুলোর মধ্যে একটি নিখুঁত ঐক্য তৈরি করতে চায়। তেমনি এর বিপরীতে আছে ‘ডেথ’ বা মৃত্যুর ইনসটিংট (থানাটোস) আগ্রাসী শক্তি; যা এই ঐক্যকে ভাঙতে চায়। ইরোস আর থানাটোসের মধ্যকার এই দ্বন্দ্বই আসলে ব্যক্তি এবং সমাজকে নির্মাণ করে। একই সঙ্গে ইরোটিক এবং স্যাডিস্টিক।
নিও-লিবারেল রাজনৈতিক-অর্থনীতির দিকে তাকালে আমরা কিন্তু সেগুলোর প্রতিফলন দেখি। সিনেমাগুলোর দিকে খেয়াল করুন। গডজিলাকে যুদ্ধ হিসেবে দেখলে- এই সিনেমাগুলো ইঙ্গিত দেয় গডজিলা তো তার নিজের টেরিটরি প্রতিষ্ঠার করবেই, বাকিদের সঙ্গে লড়াই হবেই। এতে তো ধ্বংস অনিবার্য। আর এগুলো ম্যানেজ করার জন্য দরকার মোনার্ক আর প্রচুর টেকনোলজি। (মোনার্ককে যদি ভাবে আমেরিকা, টেকনোলজি মানে যুদ্ধাস্ত্র আর গডজিলা মানে যদি যুদ্ধ ধরি?) গডজিলাকে যদি মেগা-করপোরেট হিসেবে দেখি তাহলে অ্যাপল আর গুগলের কিংবা ফেসবুকের মেগা স্পেক্টাকল দেখাই তো বাকিদের কাজ। কী কী প্রোডাক্ট লঞ্চ করল? টেসলা কী গাড়ি আনল। এক সিইও আরেক সিইওকে কী বলল? কে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধনী? ফোর্বসের তালিকায় কে এলো? গডজিলাকে যদি ‘মুসলমান’ হিসেবে ধরি? ‘মাইগ্রেন্ট’ হিসেবে ধরি? ক্রিটিকরা যতই গজিরা মাইনাস ওয়ান সিনেমার গল্পের প্রশংসা করুক না কেন অস্কারে এই সিনেমাটি কিন্তু পুরস্কার পেল বেস্ট ভিস্যুয়াল ইফেক্টে। গল্পের কি আর মূল্য থাকল? যদিও ওপেনহাইমারের পুরস্কারের তালিকা কিন্তু লম্বা। তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে কেউ প্রথমে জাপানি গজিরা আত্মীকৃত করেই শেষ হয়নি; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নায়কোচিত গল্পের মালিকানাও যে বিশেষ গোত্রের সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
তাই প্রশ্ন থাকে; গল্প কিংবা স্পেক্টাকল সবগুলোতেই গজিরা; সরি; গডজিলাটি কে?
লেখক: নৃবিজ্ঞানী, শিক্ষক, ভিস্যুয়াল তাত্ত্বিক