সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৪ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

শ্রেণিকক্ষ নেই বেরোবিতে, গাছতলায় শিক্ষার্থীরা

আপডেট : ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:২৯ পিএম

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) শ্রেণিকক্ষ সংকট দীর্ঘদিন ধরে চলমান। প্রতি বছর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পাঠদান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সম্প্রতি এই সংকট শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের উভয়ের জন্যই একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় চালুর হয় মাত্র ৩০০ শিক্ষার্থী, ১২ শিক্ষক এবং ৬টি বিভাগ নিয়ে। যেখানে বর্তমানে ২০৪ জন শিক্ষক, ৬টি অনুষদ, একটি রিসার্চ ইনস্টিটিউটসহ মোট ২২টি বিভাগ চালু রয়েছে। তবে বেশিরভাগ বিভাগেই পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই। ফলে শিক্ষার্থীদের অনেক সময় ক্লাস বাতিল করতে হয়। আবার কখনো একাধিক ব্যাচের ক্লাস একই সময়ে দেয়ার ফলে শ্রেণি সংকটে অন্য বিভাগের ক্লাসে গিয়ে ক্লাস করার মতো অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এর ফলে শিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

শ্রেণিকক্ষ সংকটে এসব সমস্যার পাশাপাশি বর্তমানে অন্যতম বড় সমস্যাগুলো হচ্ছে একাধিক ব্যাচের ক্লাস শিডিউল একটানা থাকার ফলে কোনো ক্লাসে সময়ের তারতম্য ঘটলে ঘণ্টার বেশিও দাঁড়িয়ে থাকতে হয় শিক্ষার্থীদের। আবার ক্লাস রুটিন মিলাতে শিক্ষকদেরও অফিস আওয়ারের বাইরের অতিরিক্ত সময়ে নিতে হচ্ছে ক্লাস, ক্ষেত্রবিশেষে পরীক্ষাও। তাছাড়া, ক্লাস সংকটে বেশ কয়েকটি বিভাগের শিক্ষকরা বিভিন্ন সময়ে ক্লাস নেন শ্রেণিকক্ষের বাইরে গাছের নিচে অথবা খেলার মাঠে৷ 

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগে ৫-৬টি করে ব্যাচের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছে। যেখানে কোনো কোনো বিভাগের ক্লাসরুমের সংখ্যা একটি, কোনো বিভাগের ২টি বা ৩টি। 

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রমতে, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের অন্তত ১৬টি বা তার অধিক বিভাগে শ্রেণিকক্ষ সংকট রয়েছে। 

তীব্র শ্রেণি সংকট নিরসনে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দাবি ও মানববন্ধন করলেও এখনও পর্যন্ত কোনো ফলপ্রসূ কার্যক্রম গ্রহণ করতে দেখেননি বলে জানান তারা।

বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের ক্লাস রুম মাত্র একটি। বর্তমানে বিভাগটি ৪ টি ব্যাচের অন্তত ২৫০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, লোক প্রশাসন বিভাগে শ্রেণিকক্ষ রয়েছে দুটি।

জীব ও ভূ-বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শ্রেণিকক্ষ রয়েছে দুটি। অপর দিকে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞানের শ্রেণিকক্ষ রয়েছে তিনটি।

ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস ছাড়া বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের অধীনে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ, মার্কেটিং,  অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড  ইনফরমেশন সিস্টেম ও ফাইনান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শ্রেণিকক্ষ রয়েছে মাত্র তিনটি করে। কলা অনুষদের অধীনে বাংলা, ইংরেজি ও ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শ্রেণিকক্ষ রয়েছে তিনটি করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষার্থীরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ৪টি ব্যাচের একটি মাত্র ক্লাসরুম। ক্লাসরুম সংকটের কারণে মাঝে মাঝে অন্য বিল্ডিংয়ের গণিত বিভাগের একটি ক্লাসরুমে গিয়ে আমাদের ক্লাস করতে হচ্ছে। এটি কোনো সমাধান হতে পারে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লাসের জন্য দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায় অনেকদিন ক্লাসই ক্যান্সেল হয়ে যায়। দিন যাচ্ছে শিক্ষার্থী বাড়ছে কিন্তু আমাদের ক্লাসরুম বাড়ছে না। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার কোনো পরিবেশ হয়ে উঠতে পারে না। দ্রুত এর সমাধান করা উচিত।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তের শিক্ষার্থী সবুজ মিয়া বলেন, ‘স্নাতক শেষ করলাম নানাবিধ সমস্যা নিয়ে। কতদিন যে ক্লাসের জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেছি, ক্লাসরুমের বাইরে গাছের নিচে বা মাঠে ক্লাস করেছি। আগামীতে এই শ্রেণিকক্ষ সংকট না থাকুক এটাই তো চাই। আমরা মূলত যথাযথ শিক্ষার পরিবেশ পাচ্ছি না।

শিক্ষকরা বলছেন, এই সংকট শিক্ষাদানের মানেও প্রভাব ফেলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক দেশ রূপান্তরকে জানান, যথাযথ শ্রেণিকক্ষ না থাকায় আমাদের অনেক সময় পড়ানোর পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হয়। ফলে নির্ধারিত পাঠ্যক্রম শেষ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তার ওপর বর্তমানে জট কাটিয়ে উঠতে সিলেবাসের ডিউরেশন ৬ মাসের বদলে সাড়ে ৪ মাসে নিয়ে আসা হয়েছে।

শ্রেণিকক্ষ সংকট শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রে নয়, বরং শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলছে। এ বিষয়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একাধিক শিক্ষক দেশ রূপান্তরকে বলেন, `শিক্ষার্থীরা পর্যাপ্ত পরিবেশ না পেলে তাদের পড়াশোনার আগ্রহ কমে যায়। এতে তাদের মানসিক চাপ বাড়তে পারে, যা একাডেমিক এবং ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সমস্যাটি সমাধানে সচেষ্ট হলেও কার্যকর উদ্যোগের অভাবে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ কমছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক ড. মো. ইলিয়াস প্রামাণিক দেশ রূপান্তরকে বলেন, `এই সংকট একদিনের না, দীর্ঘ ১৫ বছরের বঞ্চনার ফল এসব। বিভিন্ন সময়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা বললেও তা হয়ে উঠেনি। যেখানে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বছরের বাজেট হয় হাজার কোটি সেখানে এত বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট এসেছে মাত্র ২’শ কোটি টাকা। আশা করি খুব দ্রুত এই উপাচার্য সেসব সমস্যা সমাধান করবে। আমরা বেশ কয়েকটি উদ্যোগ ইতিমধ্যে গ্রহণও করেছে। বিশেষ শিক্ষা সহকারীও আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন আমাদের প্রস্তাবণাগুলো পাশ হবে কোনো বৈষম্য থাকবে না।’

তবে শিক্ষার্থীরা সমস্যার সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধন কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন যে বারবার আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবিক কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। মানববন্ধনে  শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা শুধু প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে ক্লান্ত। আমাদের টিউশন ফি বাড়ানো হয়, কিন্তু আমরা ন্যূনতম শ্রেণিকক্ষের সুবিধাও পাই না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগেই জেনেছি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নানাবিধ সংকটের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেখলাম শ্রেণিকক্ষ সংকট চরমে। আমরা ১ হাজার ৮০ কোটি টাকার পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছি। এটি আলোর মুখ দেখলে আমাদের এসব সমস্যা থেকে দ্রুতই কাটিয়ে উঠব। সামনে আমরা  একাডেমিক বিল্ডিংগুলো আরও বহুতল করব ফলে শ্রেণিকক্ষ সংকট থাকবে না বলে আশা করি।

 

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত