সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

বিশ্ব জুড়ে অনিশ্চয়তা-উদ্বেগ

আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৫:৪০ এএম

গত ২০ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের শপথ নেওয়ার দিনই দুই শতাধিক নির্বাহী আদেশ জারি করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যার মধ্যে রয়েছে ইসরায়েল ও মিসর বাদে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া বিদেশে সহায়তায় ৯০ দিনের স্থগিতাদেশ। এর ফলে কিছু ব্যতিক্রম বাদে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন দেশ ও সংগঠনে দেওয়া সহায়তা কার্যত বন্ধ রয়েছে। ফলে একদিকে বিশ্ব জুড়ে জীবনরক্ষাকারী অসংখ্য কর্মসূচি বন্ধ হয়ে পড়েছে; অন্যদিকে মানবিক সহায়তাকর্মীরাও তাদের কর্মসূচি চালু রাখতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ছাড়পত্র সংগ্রহ করতে কঠোর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। কয়েক ডজন সহায়তাকর্মী ও জাতিসংঘের কর্মীদের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

নিজের ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সহায়তা মানানসই কি না, তা খতিয়ে দেখতে এ স্থগিতাদেশ দেন ট্রাম্প। নির্বাহী আদেশে ট্রাম্প বলেন, বৈদেশিক সহায়তা খাত ও আমলাতন্ত্র অনেক ক্ষেত্রেই আমেরিকান মূল্যবোধের পরিপন্থী। তবে পরবর্তীকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানান, জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, চিকিৎসাসেবা, খাদ্য, আশ্রয় ও অন্যান্য অতি জরুরি সেবাসহ জীবনরক্ষাকারী মানবিক সহায়তা এ স্থগিতাদেশের বাইরে থাকবে। তবুও এ ঘোষণার পর বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও কর্মসূচিতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দাতা সংগঠন। মানবিক সহায়তাকর্মী ও জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, বৈদেশিক ও মানবিক সহায়তা খাতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন আর কখনো আগের অবস্থায় থাকবে না। এমনকি কোন কোন কর্মসূচি চালু রাখা হবে, সে বিষয়েও মার্কিন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কোনো দিকনির্দেশনা পাচ্ছেন না তারা। জেনেভায় কাজ করা এক সহায়তাকর্মী বলেন, আমাদের নিজেদের কাছে এসব কর্মসূচিতে খরচ করার মতো টাকা নেই। যুক্তরাষ্ট্র এসব খরচের অনুমোদন দেবে কি না, তা নিশ্চিত না হয়ে আমরাও কোনো কাজ করতে পারছি না। ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত বিশ্ব জুড়ে যে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, তা নিয়ে যারাই রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেছেন তাদের বেশিরভাগই তাদের নাম গোপন রাখার অনুরোধ করেছেন। এর পেছনে রয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের তোপে পড়ার ভয়।

বিশ্ব জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পৌঁছে দিতে প্রধান ভূমিকা পালন করত ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি)। ট্রাম্পের ঘোষণায় অস্থিরতা সবচেয়ে বেশি এ সংস্থাতেই। কয়েক হাজার কর্মী ছাঁটাইসহ সংস্থাটি বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। সরকারের দক্ষতা বাড়াতে কাজ করা ট্রাম্প ঘনিষ্ঠ ধনকুবের ইলন মাস্ক সংস্থাটিকে অপরাধী সংগঠন অ্যাখ্যা দিয়ে বন্ধ করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে বিশ্ব জুড়ে ইউএসএআইডির কর্মীদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর নির্দেশ আটকে দিয়েছে ওয়াশিংটনের ডিস্ট্রিক্ট জজ আদালত। এ বিষয়ে রয়টার্স যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও হোয়াইট হাউজের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও, তাতে সাড়া মেলেনি।

ট্রাম্পের সহায়তা স্থগিতে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে যুদ্ধ ও মহামারীতে বিধ্বস্ত আফ্রিকা মহাদেশের বেশ কয়েকটি দেশ। ঘানা ও কেনিয়ায় ম্যালেরিয়াবিরোধী জরুরি অভিযানে এখনো যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন অনুমোদন দেয়নি। হাইতিতে এইচআইভি রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া মানবিক সহায়তাকর্মীরাও ওষুধ ছাড়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে। ঘানা ও কেনিয়ায় চলতি মাস থেকে সহায়তাকর্মীদের ম্যালেরিয়ারোধী স্প্রে অভিযান শুরু করার কথা। বর্ষাকালে দেশ দুটিতে মশার বিপুল বংশবিস্তার ঘটে। ফলে সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। গত ডিসেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, ২০২৩ সালে বিশ্ব জুড়ে এ রোগে ৫ লাখ ৯৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর বড় অংশই পাঁচ বছরে কম বয়সী শিশু। কিন্তু অভিযান শুরু তো দূর, উল্টো বিপুল পরিমাণ কীটনাশক এবং লাখ লাখ মশারি গুদামে পড়ে আছে, বলেছেন ইউএসএআইডির এক ঠিকাদার। চলতি মাসের ৪ তারিখের ইউএসএআইডির এক মেমোতে ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা ও অন্যান্য রোগ এবং জটিল স্বাস্থ্যগত সমস্যা মোকাবিলাকে ‘জীবনরক্ষাকারী কাজ’ হিসেবে গণ্য করার কথা জানানো হয়েছে, অর্থাৎ এগুলো ট্রাম্পের স্থগিতাদেশের বাইরে থাকবে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ম্যালেরিয়া নো মোর জানায়, ট্রাম্পের সহায়তা স্থগিতের ফলে ১ কোটি ৫৬ লাখ জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম, ৯০ লাখ মশারি ও ৪ কোটি ৮০ লাখ প্রতিরোধমূলক ওষুধের বিতরণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে যে লড়াইয়ে সবচেয়ে বেশি সহায়তা দেয় যুক্তরাষ্ট্র; যার বেশিরভাগই আসে ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সময়ে চালু হওয়া প্রেসিডেন্টের ম্যালেরিয়া প্রকল্প পিএমআই থেকে। তবে ট্রাম্প শপথ নেওয়ার পর পিএমআইয়ের ওয়েবসাইটটি বন্ধ রয়েছে। ট্রাম্পের সহায়তা স্থগিতের পর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেসব কর্মসূচিকে ছাড় দিয়েছে তার মধ্যে হাইতিতে এইডস রোগীদের চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া কর্মসূচিটিও আছে। কিন্তু এটি চালু রাখতে সুনির্দিষ্ট কোনো লিখিত নির্দেশনা না পাওয়ায় কর্মসূচিটি এখনো বন্ধই আছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার এক কর্মী। এ কর্মসূচিতে অর্থ যায় পেপফার নামে পরিচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের ইমার্জেন্সি প্ল্যান ফর এইডস রিলিফ থেকে। এইচআইভির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। ট্রাম্পের এ ঘোষণায় ঝুঁকির মুখে পড়েছেন অন্তঃসত্ত্বা নারীরা। হাইতির এ কর্মসূচিতে দেওয়া ওষুধ মায়েদের কাছ থেকে নবজাতকদের মধ্যে এইচআইভির সংক্রমণ প্রতিরোধ করে। পেপফারের মাধ্যমে হাইতির দেড় লাখ এইডস আক্রান্তের অর্ধেকের বেশি চিকিৎসা পেতেন। যদিও গত ১ ফেব্রুয়ারি পেপফারের ব্যবস্থাপনায় থাকা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল কর্মসূচিটি ছাড়ের আওতায় আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফাইন্যান্সিয়াল ট্র্যাকিং সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে হাইতির মানবিক সহায়তা তহবিলের ৬০ শতাংশই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যার পরিমাণ ২০ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা জাঁকিয়ে বসেছে মিয়ানমারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বাড়তে থাকা গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটি এখন ভয়াবহ খাদ্যসংকট মোকাবিলা করছে। জাতিসংঘ বলছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির আনুমানিক ২০ লাখ মানুষ এখন দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দেশটির একক বৃহত্তম সাহায্যদাতা। ফলে বর্তমানে পরিস্থিতিকে গোলযোগপূর্ণ অভিহিত করেছেন দেশটিতে কাজ করা এক মানবিক সহায়তাকর্মী। মিয়ানমারে সহায়তা সংস্থার দুই কর্মী বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে খাদ্য সরবরাহের যে কর্মসূচি চালু ছিল সেটি ছাড়ের তালিকায় পড়েছে কি না এবং এটি চালু থাকবে কি না তা তারা জানেন না। ট্রাম্পের সহায়তা স্থগিতে ভুগতে হচ্ছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদেরও। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে জীর্ণ শিবিরে থাকা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার জন্য মানবিক সহযোগিতার প্রায় ৫৫ শতাংশই আসে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। রোহিঙ্গাদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ বলছে, মার্কিন সহায়তা স্থগিতে অনেক প্রয়োজনীয় ও জীবনরক্ষাকারী সেবা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা সেবা স্থগিত থাকায় মিয়ানমার-থাইল্যান্ড সীমান্তে সাতটি শরণার্থীশিবিরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে ইন্টারন্যাশনল রেসকিউ কমিটি (আইআরসি)। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের কারণে অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশু এবং গুরুতর অসুস্থ অনেককেই চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধ দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়েই অনেক মানুষ আইআরসি পরিচালিত কেন্দ্রগুলো ছেড়ে যান বলে জানান ব্যাংককের মহিদুল বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত ফিল্ড স্টেশন শোকলো ম্যালেরিয়া রিসার্চ ইউনিটের পরিচালক ফ্রাঁসোয়া নোস্টেন। বৈদেশিক সহায়তা বন্ধের কারণে প্রয়োজনীয় ওষুধ না পাওয়ায় অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে বলেও জানান তিনি। নোস্টেন বলেন, আপনি যদি সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেন, তাহলে অনেকেই মারা পড়বে। যা খুবই হতাশার ও হৃদয়বিদারক।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত