দেশে বর্তমানে মাত্র ২০ শতাংশ কিডনি রোগী ডায়ালাইসিস, কিডনি প্রতিস্থাপন ও অন্যান্য চিকিৎসা পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তাদের তথ্য অনুযায়ী, অবশিষ্ট ৮০ শতাংশ রোগী বিনা চিকিৎসায় ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিশ্ব কিডনি দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে এই তথ্য জানানো হয়। সেমিনারে চিকিৎসকরা জানান, দেশের ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ নারী ও ২০ শতাংশ পুরুষ। সে হিসেবে দেশে মোট কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি এবং দ্রুত হারে এ সংখ্যা বাড়ছে।
চিকিৎসকরা আরও বলেন, গত এক দশকে কিডনি রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এই মহামারীতে বছরে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল হচ্ছে ও তাদের ৯০ শতাংশই মারা যাচ্ছে।
দিবসটি উপলক্ষে কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস) ও বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন সেমিনারসহ নানা কর্মসূচি নিয়েছিল। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল- ‘আপনার কিডনি কি সুস্থ? দ্রুত পরীক্ষা করুন, কিডনি স্বাস্থ্য সুরক্ষা করুন।’
বিএসএমএমইউতে বছরে ছয় হাজারের বেশি শিশু কিডনি রোগীকে চিকিৎসা : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু কিডনি (পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি) বিভাগ ও পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ যৌথভাবে শোভাযাত্রা ও সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে শিশু নেফ্রোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. আফরোজা বেগম জানান, বিএসএমএমইউর শিশু কিডনি বিভাগের উদ্যোগে গত এক বছরের ছয় হাজারের বেশি শিশু কিডনি রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ডায়ালাইসিস দেওয়া হয়েছে ৩৮ শিশুকে।
কিছু ব্যথানাশক ওষুধ কিডনি বিকল করে দিচ্ছে : বিএসএমএমইউয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, চিকিৎসকরা যাতে আনরেজিস্ট্রার্ড প্রোডাক্ট প্রেসক্রিপশনে না লিখেন সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ব্যথানাশক ওষুধ লেখার বিষয়েও অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। একই সঙ্গে কিডনি রোগে চিকিৎসায় এভিডেন্স বেইসড মেডিসিনকে গুরুত্ব দিতে হবে, গাইডলাইন ফলো করে চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হবে।
বিএসএমএমইউর উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, কিডনি রোগ চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি গবেষণাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। চিকিৎসাসেবায় স্টেম সেল থেরাপি কিভাবে ব্যবহার করা যায়, সেই উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি ও ডিসিপ্লিনারি টু ডিসিপ্লিনারি ইন্টারেকশন কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে।
অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ও বিএসএমএমইউর নেফ্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান ডা. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, কিছু ব্যথানাশক ওষুধ রয়েছে, যা রোগীদের কোনোভাবেই সেবন করা উচিত নয়। কারণ অনেক মানুষের জীবন এ ধরনের ওষুধ সেবন করে কিডনি বিকল হয়ে যাচ্ছে। তাই এই বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য যে সকল ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, তার ওপর সরকার আরোপিত সকল প্রকার ভ্যাট ও ট্যাক্স সম্পূর্ণরূপে মওকুফ করতে হবে।
শহর ও গ্রামাঞ্চলে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ছে : ক্যাম্পস শোভাযাত্রা, পথচারীদের মধ্যে টি-শার্ট বিতরণ ও কিডনি বিষয়ক সচেতনতামূলক আলোচনা সভার আয়োজন করে। সভায় ক্যাম্পস প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ বলেন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং স্থূলতার মতো অসংক্রামক রোগের কারণে কিডনি রোগের প্রকোপ বাড়ছে। প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ লোক কোনো না কোনো কিডনি রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার কিডনি রোগী ডায়ালাইসিসের ওপর নির্ভরশীল হয়। শহর ও গ্রামাঞ্চলে সমানভাবে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। কিডনি বিকলের চিকিৎসা সর্বাধিক ব্যয়বহুল। ফলে চিকিৎসা করতে গিয়ে পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। অথচ কিডনি রোগ প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করে চিকিৎসার মাধ্যমে মরণব্যাধি কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা।
সভায় জানানো হয়, কিডনি রোগের সুলভে চিকিৎসা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে ক্যাম্পস ইতিমধ্যে ঢাকার পাশাপাশি টাঙ্গাইল, চাঁদপুর, মাদারীপুর, সখিপুর, নবাবগঞ্জ, ঝিনাইদহ ও ঘাটাইল শহরে কিডনি সেবা ও ডায়ালাইসিস কেন্দ্র স্থাপন করেছে।