উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এমন সমস্যা সমাধানের অন্যতম কার্যকর উপায় হচ্ছে স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থা। জনগণকে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনে সহায়তা করে স্বাস্থ্যবীমা দারিদ্র্য বিমোচনে রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
স্বাস্থ্যবীমা হচ্ছে, একটি আর্থিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। যেখানে বীমাগ্রহীতা নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রিমিয়াম প্রদান করেন এবং অসুস্থতার সময় বীমা প্রতিষ্ঠান তার চিকিৎসা ব্যয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ বা সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করে। এটি ব্যক্তি বা পরিবারের জন্য একটি সুরক্ষা বলয় তৈরি করে, যা রক্ষা করে আকস্মিক চিকিৎসা ব্যয়জনিত আর্থিক সংকট থেকে। স্বাস্থ্যবীমার আওতায় হাসপাতালের বিল, ডাক্তার ফি, ওষুধ, ল্যাব পরীক্ষা, অপারেশন, জরুরি চিকিৎসা, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও প্রতিরোধমূলক সেবাও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। স্বাস্থ্যবীমার মাধ্যমে চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ কমে, রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার প্রসার ঘটে এবং কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়, যা সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্য বিমোচন ও জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে সচেতনতার অভাব, উচ্চ প্রিমিয়াম, দুর্নীতি ও স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা এর কার্যকারিতা ব্যাহত করতে পারে, যা সমাধানের জন্য সরকার ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় স্বাস্থ্যবীমার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
ধনী-দরিদ্র সব শ্রেণির মানুষের জন্য স্বাস্থ্যবীমাকে সহজলভ্য ও কার্যকর করা প্রয়োজন। এ জন্য সরকারি, বেসরকারি এবং নাগরিক সংগঠনগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রথমত, সরকারকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে স্বাস্থ্যবীমা পরিকল্পনা চালু করতে হবে, যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী মানসম্মত চিকিৎসা সুবিধা পেতে পারে। দ্বিতীয়ত, কর্মস্থলভিত্তিক স্বাস্থ্যবীমা বাধ্যতামূলক করা যায়, যেখানে চাকরিজীবীরা সহজেই এই সুবিধা পান। তৃতীয়ত, বেসরকারি বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন আয় স্তরের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী ও নমনীয় প্রিমিয়াম কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে, যাতে ধনী ও দরিদ্র উভয়েই উপযোগী স্বাস্থ্যবীমা গ্রহণ করতে পারেন। চতুর্থত, স্বাস্থ্যবীমা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি, যাতে মানুষ এর গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং যথাযথভাবে ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হয়। পঞ্চমত, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের প্রোডাক্ট যেমন : এফডিআর/ডিপিএস/ক্রেডিট কার্ড গ্রহীতাকে স্বাস্থ্যবীমা সুবিধা প্রদান করা যায়। এ ছাড়া ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সহজে বীমা গ্রহণ ও দাবি (ক্লেইম) প্রক্রিয়াকে দ্রুততর ও স্বচ্ছ করতে হবে। সবশেষে, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (চচচ) মডেলে একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্যবীমা কাঠামো তৈরি করা সম্ভব হলে, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পেতে সক্ষম হবে, যা সামগ্রিকভাবে দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাবে। ডিজিটাল তথ্যভা-ার গড়ে তুলে হাসপাতাল, বীমাগ্রহীতা ও কোম্পানির মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো জরুরি। জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা রোধে আধুনিক মনিটরিং ব্যবস্থা প্রণয়ন প্রয়োজন। পাশাপাশি, স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হলে এটি দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যবীমার প্রিমিয়াম পরিশোধ করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে তারা এই সুরক্ষা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। এই সমস্যা সমাধানে সরকার বিশেষ মেগা প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে, যেখানে সরকারি ভর্তুকি ও বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। সরকার দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য স্বল্পমূল্যের বা বিনামূল্যের স্বাস্থ্যবীমা চালু করতে পারে, যা করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (ঈঝজ) এবং আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর সহায়তায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
স্বাস্থ্যবীমা বাস্তবায়নের পথে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো, সচেতনতার অভাব। অনেক মানুষ এখনো স্বাস্থ্যবীমার গুরুত্ব বুঝতে পারে না বা এ সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য জানেন না। বিশেষ করে, দরিদ্র ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই সচেতনতার ঘাটতি বেশি দেখা যায়। অনেকেই মনে করেন, স্বাস্থ্যবীমা শুধু ধনী বা চাকরিজীবীদের জন্য। ফলে তারা এতে আগ্রহী হয় না। এ ছাড়া বীমাসংক্রান্ত জটিলতা ও ভুল ধারণার কারণে অনেকেই মনে করেন, এটি ঝামেলাপূর্ণ বা প্রতারণামূলক হতে পারে। এ ধরনের সমস্যা সমাধানে ব্যাপক প্রচার ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, স্থানীয় কমিউনিটি সভা ও অনেক সময় নিম্ন আয়ের মানুষ বীমার নিয়মিত কিস্তি বা প্রিমিয়াম পরিশোধ করতে অসমর্থ হয়, ফলে তারা স্বাস্থ্যবীমার সুবিধা গ্রহণ করতে পারে না। বিশেষ করে বেসরকারি স্বাস্থ্যবীমাগুলোর ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম তুলনামূলক বেশি হওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী এতে অংশ নিতে আগ্রহী হয় না।
সরকার দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য ভর্তুকিসহ স্বাস্থ্যবীমা চালু করতে পারে, যাতে তারা স্বল্প খরচে বীমার আওতায় আসতে পারেন। এ ছাড়া কর্মস্থলভিত্তিক বীমা সুবিধা বৃদ্ধি করা গেলে অনেক শ্রমজীবী মানুষ সহজেই স্বাস্থ্যবীমার সুবিধা পাবেন। স্বাস্থ্যবীমা খাতে দুর্নীতি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক ক্ষেত্রে বীমা কোম্পানিগুলো সঠিক সময়ে গ্রাহকদের ক্লেইম পরিশোধ করে না বা অপ্রয়োজনীয় জটিলতা তৈরি করে। এর ফলে ভুক্তভোগীদের উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা পেতে বিলম্ব হয়। এ ছাড়া কিছু অসাধু বীমা প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রিমিয়াম আদায় করলেও বাস্তবে তারা প্রতিশ্রুত সেবা প্রদান করে না। বীমা কোম্পানির স্বচ্ছ, দক্ষ ও ন্যায়নীতিপূর্ণ মালিকানার অভাবের কারণে অব্যবস্থাপনা দেখা যায়, যা পুরো স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা সৃষ্টি করে এবং স্বাভাবিকভাবেই বীমা কোম্পানিগুলো টেকসই হয় না। এ সমস্যা সমাধানে সরকারের কঠোর নীতিমালার কার্যকর প্রয়োগ প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থাকে কার্যকর ও জনবান্ধব করতে হলে দুর্নীতি দমন, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। স্বাস্থ্যবীমার কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সুসংগঠিত ও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো, কিন্তু অনেক দেশে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। গ্রাম ও দূরবর্তী অঞ্চলে মানসম্মত হাসপাতাল, চিকিৎসক এবং আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব থাকায়, স্বাস্থ্যবীমার আওতায় এসেও অনেক মানুষ প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় রোগীদের বেসরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভর করতে হয়, যা ব্যয়বহুল এবং বীমা কাভারেজ সবসময় সেখানে প্রযোজ্য হয় না। এ সমস্যা সমাধানে সরকারকে স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং গ্রামীণ ও অনুন্নত অঞ্চলে হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক ও মেডিকেল সুবিধা সম্প্রসারণ করতে হবে।
লেখক: গবেষক ও লেখক