একটি গণঅভ্যুত্থানে অসংখ্য মানুষ হতাহত হন। সেই গণঅভ্যুত্থান যখন সফলতার মুখ দেখে, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে নিহত-আহতদের জন্য অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের কী দায়িত্ব? যে মানুষের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে সরকারের পথচলা, নৈতিকভাবেই তাদের পাশে থাকার দায়বদ্ধতা চলে আসে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার সেই পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি। চলতি বছরের শুরুতেই জানা গেছে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবার ও আহতদের জন্য ৬৩৭ কোটি ৮০ লাখ টাকার বাজেট বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। গত ৬ জানুয়ারি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড পেজে এ তথ্য জানিয়েছিলেন অন্তর্র্বর্তী সরকারের সেই সময়ের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তখন আরও জানা যায় বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্য থেকে শহীদ পরিবারের জন্য ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র এবং আহতদের বিভিন্ন ক্যাটাগরি অনুযায়ী এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হবে। নাহিদ ইসলাম জানান, বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে ২৩২ কোটি ৬০ লাখ টাকা চলতি অর্থবছরের বাজেট থেকে ব্যয় হবে। বাকি টাকা ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট থেকে বরাদ্দ করা হবে। নাহিদ ইসলাম তখন আরও জানান, প্রক্রিয়া অনুযায়ী শহীদ পরিবারকে জানুয়ারিতে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র এবং জুলাইতে ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র হস্তান্তর করা হবে। একইসঙ্গে আহতদের নগদ অর্থের পাশাপাশি চিকিৎসার প্রাসঙ্গিক ব্যয়ও পর্যায়ক্রমে মেটানো হবে।
এবার জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে যারা আহত হয়েছেন তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অর্থ বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। সংস্থাটি মনে করে, আহতদের কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং কর্মের ব্যবস্থা করতে হবে। নিহতের স্বজনদের জন্য কর্মমুখী বৃত্তিমূলক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। রবিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে ‘জাতীয় বাজেট ২০২৫-২৬ : সিপিডির সুপারিশমালা’ শীর্ষক বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেন তারা। অনুষ্ঠানে মূল প্রস্তাব তুলে ধরেন সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতাদের মধ্যে আহত হয়েছেন ২৪ হাজার ও ১ হাজার ৬০০ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম। গত বছরের ১ নভেম্বর শাহবাগে সংবাদ সম্মেলনে এমন কথা জানান জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম। প্রাথমিকভাবে নিহতের পরিবার পাঁচ লাখ ও আহতের পরিবার এক লাখ টাকা করে সহায়তা পাবে। একই সঙ্গে আহতদের মধ্যে যারা কাজ করতে অক্ষম তাদের সারা জীবন ধরে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। তথ্য বলছে, গণঅভ্যুত্থানে প্রায় ১ হাজার ৬০০ নিহত ও ২৪ হাজার ছাত্র-জনতা আহত হয়েছে। তাদের পরিবারকে সহায়তা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে ফাউন্ডেশনটি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) কার্যালয়ের প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, ‘জুলাই আন্দোলনের সময় প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত এবং ১৪ হাজার ২৫ জন আহত হয়।’ সিপিডির কার্যালয়ে বাজেট সুপারিশ উপস্থাপনের সময় তিনি বলেন, ‘এসব ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের জন্য তহবিল বরাদ্দ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ একই সঙ্গে গণঅভ্যুত্থানে আহত বা অঙ্গ হারানো যারা এখনো স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেননি, এই ডিগ্রি সম্পন্ন করা পর্যন্ত তাদের জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরে একটি বৃত্তি কর্মসূচি চালু করতে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে সিপিডি।
গণঅভ্যুত্থানে আহত-নিহতদের জন্য অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি প্রশংসনীয়। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। কিন্তু বিতরণ প্রক্রিয়ায় যেন কোনো ধরনের প্রশ্ন না ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের আজকের পথচলা যাদের রক্তের বিনিময়ে, তাদের প্রতি প্রত্যেক গণতন্ত্রকামী মানুষের সর্বোচ্চ সহানুভূতি এবং ভালোবাসা রয়েছে। এ বিষয়ে যেন কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না হয়। আমরা যেন ভুলে না যাই, বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকার তাদেরই রক্তধোয়া গণতান্ত্রিক শক্তি।