যখন আমরা হোটেলের কথা ভাবি, তখন আমাদের মাথায় আসে বিলাসবহুল স্যুইট, সুইমিং পুল আর নানান ধরনের সুবিধা। তবে আপনি কি কখনো ভাবতে পেরেছিলেন, পৃথিবীতে এমন কিছু হোটেলও আছে, যা স্বপ্নের মতো অদ্ভুত এবং চমকপ্রদ? সে রকম কিছু মজার হোটেল নিয়ে লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব
বরফের রাজ্য থেকে শুরু করে মরুভূমির বুকে, পানির নিচে থাকা হোটেল, কিংবা এক রুমের হোটেল এগুলো শুধুমাত্র গন্তব্য নয়, বরং এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। চলুন, এমন কিছু জায়গার গল্প জানি, যেখানে হোটেলের দেয়াল, ছাদ, আসবাবপত্রও এমন কিছু অদ্ভুত উপাদান দিয়ে তৈরি, যা আপনাকে অবাক করে দেবে।
বরফের বিছানায় ঘুম
বরফের হোটেল এই নামটাও শুনলে কেমন একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা অনুভূতি আসে, তাই না? কিন্তু সত্যি বলছি, এখানে থাকা-খাওয়ার সব ব্যবস্থা রয়েছে, যা একেবারে অবিশ্বাস্য। ৬ হাজার বর্গমিটার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা এই বরফের হোটেলটি যেন শান্তি আর শীতলতার এক পবিত্র আবেশে ঘেরা, যা পর্যটকদের জন্য এক আদর্শ ঠাণ্ডা অভিজ্ঞতা। আপনি কি কখনো ভাবতে পেরেছিলেন যে বরফের বিছানায় ঘুমানো যেতে পারে? এই হোটেলে থাকতে হলে আপনাকে বরফের বিছানায় শুতে হবে কিন্তু চিন্তা করবেন না, এর জন্য রয়েছে বিশেষ থারমাল সিøপিং ব্যাগ, যা আপনাকে তাপমাত্রার শীতলতা থেকে রক্ষা করবে। এই হোটেলটি সুইডেনের জুকাসজার্ভির কিরুনা থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তবে ছোট শিশুদের জন্য এটা উপযুক্ত নয়, কারণ এখানে তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি। আর সপ্তাহান্তেএখানে থাকার খরচ প্রায় এক হাজার ডলার। সব থেকে মজার বিষয়ের একটি হলো বরফের হোটেলটি প্রতিবছর নতুন করে নির্মাণ করা হয়। মার্চ মাসে হোটেলের কাছের তোরণে নদী থেকে ৫ হাজার টন বরফ সংগ্রহ করা হয়, যা গ্রীষ্মকাল জুড়ে গুদামজাত করে রাখা হয় এবং পরবর্তী সময়ে সেই বরফ দিয়েই হোটেলটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু বসন্তে, যখন সুইডেনে গরম হাওয়া বইতে শুরু করে, তখন এই বরফের রাজ্য একেবারে গলে গিয়ে মিশে যায়। এখানে বছরের পর বছর বিভিন্ন নতুন ডিজাইন তৈরি হয়, যেমন বরফে তৈরি বিশাল আফ্রিকান হাতি এবং রুশ রাজকীয় থিয়েটারের মতো বিস্ময়কর নকশা।
শীতলতায় ভরা এই হোটেলটির ভেতরে তাপমাত্রা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি থাকে, আর বাইরে তো মাইনাস ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত চলে যায়। প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এখানে আসেন এক অবিস্মরণীয় শীতল অভিজ্ঞতা নিতে। এখানে একবার এলে, আপনি বুঝতে পারবেন শীতের রাজ্যে কাটানো এক বিশেষ রাত কেমন হতে পারে।
লবণ হোটেল
বলিভিয়ার লাপাজ থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সালার দি উয়ুনি, যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সল্ট ফ্ল্যাট। এখানেই রয়েছে ‘প্যালেসিও দি সল’ বা লবণের প্রাসাদ, যা আসলে পুরোপুরি লবণ দিয়ে তৈরি। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এই এলাকায় প্রথম লবণের হোটেল নির্মাণ করা হয়, তবে কিছু সমস্যার কারণে ২০০২ সালে সেটি ভেঙে ফেলা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০০৭ সালে নতুন করে নির্মিত হয় ‘প্যালেসিও দি সল’। হোটেলটি প্রায় এক মিলিয়ন লবণের ব্লক দিয়ে তৈরি, যার প্রতিটি ব্লক প্রায় ৩৫ সেন্টিমিটার পুরু। হোটেলের মেঝে, দেয়াল, ছাদ, এমনকি আসবাবপত্রও লবণ দিয়েই তৈরি।
সালার দি উয়ুনি একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্থান, কিন্তু এখানে বিশ্রামের জন্য আগে কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই পর্যটকদের জন্য একটি হোটেল নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু এলাকায় প্রয়োজনীয় নির্মাণ সামগ্রী পাওয়া না যাওয়ায় বুদ্ধি খরচ করে লবণ ব্যবহার করে গড়ে তোলা হয় এই অনন্য হোটেল। এখানে এক রাত থাকার খরচ প্রায় ১৫০ ডলার।
পানির নিচে হোটেল
পানির নিচে হোটেল এমন একটি জায়গায় থাকার কথা ভাবুন, যেখানে চারপাশে শুধু পানি আর পানির নিচের প্রাণীরা আপনাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ঘুরছে। মালদ্বীপের *দ্যা কনরাড মালদ্বীপ রাঙ্গাইল আইল্যান্ড* এই ধরনের এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। যখন আপনি এখানে পৌঁছাবেন, তখন আপনি এক অদ্ভুত শান্তিআর মুগ্ধতায় ডুবে যাবেন। বিশাল স্যুইটটি পুরোপুরি পানির নিচে তৈরি এবং এর জানালা দিয়ে আপনি দেখতে পাবেন পানির নিচে সাঁতার কাটছে রঙিন মাছ, প্রবালের মধ্যে চলাফেরা করছে জীববৈচিত্র্য এটা সত্যিই কোনো সিনেমার দৃশ্য মনে হবে।
এখানে এক রাত কাটানো মানে জীবনের সবচেয়ে রোমান্টিক অভিজ্ঞতা অর্জন করা। আপনি যদি আপনার সঙ্গীকে বিশেষ কিছু উপহার দিতে চান, তাহলে এটা নিঃসন্দেহে হতে পারে সেরা জায়গা। পানির নিচে বসে প্রকৃতির অসীম সৌন্দর্য উপভোগ করা এটা এক অদ্ভুত অনুভূতি। কল্পনা করুন, আপনি যদি একদিন পানির নিচে একটি হোটেলে থাকতে চান, তা হলে এই অভিজ্ঞতা আপনার চিত্তের এক নতুন স্তরে নিয়ে যাবে।
তবে, পানির নিচে এই ধরনের হোটেল নির্মাণের কিছু সমস্যা রয়েছে যা প্রকৃতির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বড় জলাশয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি হওয়া, প্রবাল প্রাচীরের ক্ষতি এবং সামুদ্রিক জীবজন্তুদের জন্য ক্ষতির সম্ভাবনা এই সব কিছুই পরিবেশগত দিক থেকে গুরুত্ব সহকারে ভাবা উচিত। তবে, যদি আমরা প্রকল্পগুলোর পরিচালনা সঠিকভাবে করি, তখন আমরা প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং বিলাসিতার একটি চমৎকার মিলন দেখতে পাব।
হ্যাঁ, পানির নিচে হোটেলে থাকার অভিজ্ঞতা শুধু বিলাসিতা নয়, বরং প্রকৃতির গভীরে গিয়ে নতুনভাবে তাকে অনুভব করার এক সুযোগ। সাঁতার কাটতে থাকা মাছ, শৈল, প্রবালের মধ্যে এক রোমান্টিক সন্ধ্যা কাটালে তার স্মৃতি চিরকাল থাকবে, ঠিক যেমনটা আপনি কখনো কল্পনাও করতে পারবেন না।
একমাত্র রুম, একমাত্র হোটেল
আপনি যদি মনে করেন, হোটেলে থাকার জন্য শুধু বিলাসিতা আর পাঁচতারা হোটেলের স্বাচ্ছন্দ্যই প্রয়োজন, তাহলে সুইডেনের আটার ইন এ গিয়ে আপনার ধারণা একেবারে পালটে যাবে। কল্পনা করুন, একদিকে বিশাল পানির নীল জলরাশি, অন্যদিকে একমাত্র একটি রুম এবং আপনি সেই রুমে, ঠিক মাঝখানে, পানির নিচে বসবাস করছেন, জলজ প্রাণী আর উদ্ভিদের মধ্যে। এটা এমন একটি অভিজ্ঞতা, যা হয়তো সিনেমায় দেখা যায়, কিন্তু এখানে তা বাস্তব হয়ে ঘটছে।
আটার ইন সুইডেনের লেক ম্যাল্যারেন-এ অবস্থিত, যা সুইডেনের তৃতীয় বৃহত্তম স্বাদু পানির লেক। তবে এই হোটেলের সবচেয়ে বিশেষ বিষয় হলো এখানে শুধুমাত্র একটি রুম রয়েছে। হ্যাঁ, একেবারে একমাত্র ঘর, আর সেখানেই আপনাকে থাকতে হবে। মানে, আপনি যদি কাউকে নিয়ে আসেন, আপনার জন্য আর কোনো অন্য রুম নেই। আপনার একমাত্র সঙ্গী হবে পানির নিচে থাকা জলজ প্রাণী আর উদ্ভিদ, আর পুরো পরিবেশটা হবে শান্ত ও নিঃশব্দ।
এই হোটেলটির সবচেয়ে মজাদার এবং অদ্ভুত দিক হলো এটি আসলে এক ধরনের অ্যাকুয়ারিয়াম। আপনি ভাবতে পারেন, ‘এটা কি শুধু নামেই জলজ?’ কিন্তু আপনি ভুল ভাবছেন। আটার ইন-এর রুমটি পানির নিচে অবস্থিত এবং সেখানে থাকাকালে আপনি মাছের ঝাঁক, জলজ উদ্ভিদ এবং প্রাণী দেখতে পাবেন। এখানে শুধু ঘুমালেই হবে না, আপনি চাইলে মাছেদের সঙ্গে একটু ‘দুষ্টুমি’ও করতে পারেন তবে চিন্তা করবেন না, মাছেরা আপনাকে পানির নিচে টেনে নিয়ে যাবে না।
হোটেলের পুরো পরিবেশই একটু ভিন্ন এখানে ভাসমান কেবিন এবং ডেক রয়েছে, যেখানে আপনি চাইলে স্নান করতে করতে পানিতে ভেসে যেতে পারেন। তবে সাবধান। হোটেলের ভেতরে একমাত্র ঘর রয়েছে এবং আপনি যদি সেখানে স্নান করতে চান তাহলে সরু সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে অথবা ডিঙি নৌকায় করে যেতে হবে, যা হোটেল কর্র্তৃপক্ষ সরবরাহ করবে। সুতরাং, যদি আপনি রোমান্টিক কোনো পরিকল্পনা করেন, তাহলে সেটা একটু ভালোভাবে মেপে মেপে করা উচিত।
এটা একেবারে প্রাচীন যুগের মতো আপনাকে এখানে পৌঁছানোর জন্য একটি ছোট ডিঙি নৌকায় চড়তে হবে। তবে চিন্তা করবেন না হোটেল কর্র্তৃপক্ষই আপনাকে নৌকাটি সরবরাহ করবে। একবার পৌঁছে গেলে, আপনি পাবেন সেই একমাত্র রুম, যেটি পানির নিচে সুরক্ষিত।
সূর্য, বালি এবং বিলাসিতা
মরুভূমি এটা এমন এক জায়গা যেখানে এক কাপ ঠাণ্ডা জলও যেন অবিশ্বাস্য এক সম্পদ। কিন্তু আপনি যদি একবার মরুভূমির মাঝখানে বিলাসবহুল হোটেলে থাকার সুযোগ পান, তাহলে আপনার ধারণা একেবারে পালটে যাবে। আর সেই সুযোগটি দিচ্ছে দুবাইয়ের আল মাহা রিসোর্ট, যা মরুভূমির বুকে এক রাজকীয় অভিজ্ঞান। এই হোটেলটি যেখানে অবস্থিত, সেখানকার সৌন্দর্য আর বিলাসিতা এক অদ্ভুত মিশ্রণ এটা দেখে আপনি ভাবতে বাধ্য হবেন, ‘এটা কি আসলেই সম্ভব?’
ভাবুন তো, চারপাশে শুধু বালি আর আকাশ, আর আপনি উঁচু বালির পাহাড়ের কোলে বসে সূর্যাস্ত দেখছেন, আর এর সব কিছুই বিলাসবহুল স্যুইট থেকে। আল মাহা রিসোট-এ থাকতে হলে অবশ্য সূর্য আর বালি সম্পর্কিত ব্যাপারগুলো আপনাকে ভালোবাসতে হবে, কারণ মরুভূমির তাপমাত্রা কখনো ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে চিন্তা করবেন না এই হোটেলে থাকার অভিজ্ঞতা এতটাই অভিজ্ঞানপূর্ণ যে তাপমাত্রা আপনার কাছে কিছুই মনে হবে না।
হোটেলের রুমের জানালা দিয়ে আপনি দেখতে পাবেন এক বিস্তীর্ণ বালির মরুভূমি, আর রুমের ভেতরে যা রয়েছে, তা আপনার কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাবে। মার্বেল মেঝে, অভিজ্ঞান ফার্নিচার, ব্যক্তিগত পুল, আর বিলাসবহুল সার্ভিস এটা সত্যিই এক রাজকীয় অভিজ্ঞতা। তবে এখানকার সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা হলো, এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে একেবারে চোখ ধাঁধানো, তা দেখলে আপনি তাপমাত্রার কথা ভুলেই যাবেন।
তবে, আল মাহা রিসোর্ট শুধুমাত্র বিলাসিতার জায়গা নয় এখানে সাহসিকতা আর অ্যাডভেঞ্চারের মিশ্রণও পাওয়া যাবে। আপনি চাইলে মরুভূমির সাফারি করতে পারেন, যেখানে গাড়ি নিয়ে বালির ঢেউয়ের ওপর দিয়ে যাওয়া হবে, কিংবা উটের সওয়ারও উপভোগ করতে পারবেন। মরুভূমির তাপমাত্রা একদিকে চ্যালেঞ্জিং, অন্যদিকে এই হোটেল আপনাকে বিলাসিতায় ভাসিয়ে দেবে। তবে যদি আপনি এক্সট্রিম তাপমাত্রায় অস্বস্তি অনুভব করেন, তবে বুঝবেন মরুভূমি আপনাকে আসলেই এক সাহসিকতার পরীক্ষায় ফেলতে প্রস্তুত।