বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা শ্রম বাজারের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। যার ফলে উচ্চশিক্ষিত হয়ে বের হওয়ার পরও চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে যত শিক্ষিত হচ্ছে, তত বেকারত্ব বাড়ছে। এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প নেই। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর দক্ষতা অর্জন করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি চাকরির পেছনে না ছুটে কীভাবে উদ্যোক্তা হওয়া যায়, সে বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
গতকাল বুধবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ‘যুবদের সংস্কার ভাবনা : কর্মসংস্থান স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তাদের আলোচনায় এ কথা বলা হয়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এ সেমিনার আয়োজন করে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশের উচ্চশিক্ষা শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যা শেখানো হচ্ছে, তার বাস্তব প্রয়োগ নেই, বাজারেও চাহিদা নেই। ফলে যত শিক্ষিত হচ্ছে, তত বেকারত্ব বাড়ছে।
তিনি বলেন, যুবসমাজকে চাকরির প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন নিরীক্ষার দিকে যেতে হবে। বিসিএস কিংবা একটি নির্দিষ্ট সরকারি চাকরি পাওয়ার স্বপ্নে আটকে না থেকে নিজস্ব দক্ষতা ও আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে হবে। তিনি বলেন, শুধু সার্টিফিকেট নয়, অন্তর্গত দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের মাধ্যমে নিজ উদ্যোগে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সময় এখন। আমরা ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশনের কথা বললেও এখনো থার্ড ইন্ডাস্ট্রির ধাপই পার হতে পারিনি।
ডিজিটাল লিটারেসি, ইন্টারনেটের অ্যাকসেস, ন্যায্য খরচ ও দক্ষতা বিকাশের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশে বসে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে, কিন্তু ইন্টারনেটের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ সেই উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করছে।
কারিকুলাম উন্নয়ন ও বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণের অভাব, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রস্তুতির দুর্বলতা, বিদেশি শ্রমবাজারে অধিকতর দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা এবং ভাষাগত দক্ষতার উন্নয়নের কথা তিনি স্পষ্ট করে বলেন। ফাহমিদা বলেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট কমানোকে যুক্তিসংগত দেখানোর চেষ্টা হলেও বাস্তবে বাজেট ব্যবহারে মন্ত্রণালয়গুলোর পিছিয়ে থাকার মূল কারণ প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাব। বিনিয়োগ ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা ও কর্মসংস্থান সম্ভব নয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের বেকারত্বের বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমি সম্প্রতি যশোরে গিয়ে এমএ পাস করা পাঁচজন তরুণকে পিঠা বানাতে দেখেছি। তারা জানাল, চাকরি না পেয়ে পিঠার ফ্যাক্টরি করেছে এবং ভবিষ্যতে একে রপ্তানিমুখী করতে চায়।’ তার মতে, আমেরিকায় গিয়েও মানুষ ট্যাক্সি চালায় বা রেস্টুরেন্টে কাজ করে, কিন্তু বাংলাদেশে এমন কাজ করলে সামাজিক বাধা আসে।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, প্রচলিত ধারণা ভাঙতে হবে যে সরকারি চাকরিই একমাত্র গন্তব্য। একটি কারিগরি স্কিল দিয়ে ছোট একটি উদ্যোগ শুরু করলেও সম্মানজনক কর্মসংস্থান সম্ভব। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে এ ধরনের উদ্যোগ আরও বেশি প্রয়োজন।
নারী শ্রমশক্তির প্রসারে ডে-কেয়ার সেন্টারের অভাব ও কর্মপরিবেশের সমস্যার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, গার্মেন্টসসহ অনেক খাতে কর্মরত নারীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি না হলে তাদের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সরকারি ইউনিভার্সিটি বা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোর গবেষণার পরিধি বাড়াতে হবে। বর্তমান শ্রমবাজার ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতে না পারলে ‘স্কিল মিসম্যাচ’ সমস্যা আরও বাড়বে।
সেমিনারে আলোচকরা বলেন, বাজেট বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, সেই বাজেট বাস্তবায়নে সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা ও জীবনের মানোন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার গুণগত মান অর্জন সম্ভব নয়। উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ বিনিয়োগ প্রবেশাধিকার, ব্যাংক সহায়তা ও ভোকেশনাল প্রশিক্ষণের পরিবেশ তৈরি করা না গেলে কর্মসংস্থানের লক্ষ্য পূরণ অসম্ভব হবে।