আশরাফুল ইসলাম রানা। তারকা খরায় ভুগতে থাকা দেশের ফুটবলে যে কজন নিজেদের আলাদা করে চিনিয়েছিলেন, তাদেরই একজন। তেকাঠির নিচে বিগত দেড় দশকে যে কজন গোলরক্ষক ছিলেন সেরার আলোচনায়, তাদেরই একজন রানা। আজ তিনি ইতি টানতে যাচ্ছেন দীর্ঘ ফুটবল ক্যারিয়ারের। কুমিল্লায় ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে আজ প্রিমিয়ার লিগে মাঠে নামবেন এর মধ্যেই লিগ শিরোপা নিশ্চিত করা মোহামেডানের বিপক্ষে। ক্যারিয়ারের শেষটা তিনি মেলাতে যাচ্ছেন শুরুর সঙ্গে। পেশাদার ফুটবলের শুরুটা হয়েছিল সাদা-কালো জার্সিতে। আজ শেষটায়ও থাকছে মোহামেডান। তবে রানা শেষ ম্যাচটি খেলবেন প্রিয় দলের প্রতিপক্ষ হিসেবে।
বয়স ৪০ ছুঁইছুঁই। তার শুরুর সঙ্গীদের বেশিরভাগ সাবেক বনে গেছেন। রানা ব্যতিক্রম। বয়সকে স্রেফ সংখ্যায় রূপ দিতে ফিটনেসে তার নজর ছিল সবসময়। পেটানো শরীরে এ মৌসুমেও খেলেছেন নিয়মিত। ব্রাদার্সের হয়ে লিগ ও ফেডারেশন কাপে তিনবার পেয়েছেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। ফর্ম আর ফিটনেস থাকতে থাকতেই অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত শুধুই তরুণদের সুযোগ করে দিতে। আর ১০ জনের মতো বোঝা হয়ে ক্যারিয়ার লম্বা করতে চাননি। একটা বড় সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হয়ে খেলা রানা, ‘অবসরের কারণ স্রেফ নতুনদের সুযোগ করে দেওয়া। এটাই অবসরের সঠিক সময় মনে হয়েছে। আর মোহামেডানের বিপক্ষে ম্যাচকে বেছে নেওয়ার কারণ এই ক্লাবের হয়েই আমার পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয়েছিল। প্রিয় ক্লাবের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটা খেলে বুট ও গ্লাভস জোড়া খুলে রাখব।’
মানিকগঞ্জের কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসে শুধু জাতীয় দলেই খেলেননি, অধিনায়কত্বের সম্মানও পেয়েছিলেন রানা। তবে অধিনায়কত্বের সেই স্মৃতি ভুলে যেতে চান তিনি, ‘২০১৬ সালে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের দুই ম্যাচ আমার নেতৃত্বে খেলেছিল বাংলাদেশ। সেবার ভুটানের বিপক্ষে দুটি ম্যাচের আগে আমার নাম অধিনায়ক হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে আক্ষেপ হলো সেই দুই ম্যাচের একটি ড্র ও একটি হেরে আমরা ১৬ মাসের জন্য আন্তর্জাতিক নির্বাসনে চলে গিয়েছিলাম। এই দুঃস্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়।’
জাতীয় দলের ক্যাম্পে প্রথম ডাক পেয়েছিলেন ২০১৫ সালে মোহামেডানে খেলার সুযোগ পাওয়ার পরপরই। এরপর থেকে জাতীয় দলে নিয়মিত খেলেছেন ২০২২ সাল পর্যন্ত। একটু বেশি বয়সেই পেশাদার ফুটবল শুরু করতে হয়েছিল তাকে। এর কারণ দীর্ঘদিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে থাকায়। রানা অবশ্য ফুটবলার হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে সেনাবাহিনীর বড় অবদানের কথা বলেছেন, ‘আমার অ্যাকাডেমিক কোনো ফুটবল শিক্ষা নেই। গ্রামে ছোটবেলায় খেলতাম। বড় ভাইরা সবাই স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতেন। আর ছোটদের জোর করে দাঁড় করিয়ে দিতেন পোস্টের নিচে। আমার ক্ষেত্রেও তেমনই হয়েছিল। এভাবেই গোলকিপার হয়ে ওঠা। আর ফুটবলকে পেশা হিসেবে নিতে বড় ভূমিকা রেখেছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ২০০৩ সালে আর্মিতে যোগ দিয়েছিলাম ফুটবলার হিসেবে। সেখানে লম্বা সময় খেলেছি। তবে আর্মিতে থাকলে পেশাদার ফুটবলার হওয়ার সুযোগ ছিল না। জাতীয় দলেও হয়তো কখনো খেলতে পারতাম না। বিষয়গুলো নিয়ে আর্মির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলি এবং মুক্তিযোদ্ধা, মোহামেডান, শেখ জামালসহ বিভিন্ন ক্লাবে যোগাযোগ করি। ২০১৪ সালে আলফাজ ভাই, নকীব ভাই ও সাবেক ম্যানেজার আমিরুল ইসলাম বাবু ভাই আমাকে মোহামেডানে নেন। পেশাদার ফুটবলার পরিচয়টা প্রথম মোহামেডান থেকেই পেয়েছি। মোহামেডানের হয়ে এক ম্যাচ খেলার পরেই জাতীয় দলে ডাক পাই। তখন থেকে কন্টিনিউ ২০২২ সাল পর্যন্ত খেলেছি জাতীয় দলে।’
শহীদুল আলম সোহেল, মাজহারুল ইসলাম হিমেল, আনিসুর রহমান জিকোদের সঙ্গে লড়াই করতে হতো জাতীয় দলের একাদশে সুযোগ পেতে। বয়সে তাদের চেয়ে বেশি হলেও রানা ঠিকই দেশের হয়ে খেলেছেন ২৫ ম্যাচ। এর মধ্যে ৯ ম্যাচ দলকে ক্লিনশিট রাখতে পারেন। জাতীয় দলে খেলাটা তাই রানার কাছে বিশেষ কিছু, ‘আলহামদুলিল্লাহ, জাতীয় দলে অনেক ভালো সময় কাটিয়েছি। আমার জীবনের সেরা অর্জন বলতে পারেন। জাতীয় দল আমাকে বাংলাদেশের রানা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। একটি অজপাড়াগাঁয়ের কৃষক পরিবার থেকে এসে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা আমার জন্য বিশাল একটা ব্যাপার। বাংলাদেশ দলে খেলাটা মোটেই সহজ ছিল না। এজন্য আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ।’
প্রায় এক যুগ সেনাবাহিনীর চাকরি করে রানা আসেন মূল ধারার ফুটবলে। মোহামেডান দিয়ে শুরু। এরপর চট্টগ্রাম আবাহনী ও ধারে সাইফ স্পোর্টি ক্লাব ঘুরে তিনি থিতু হন শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রে। পাঁচ বছর এই ক্লাবের পোস্ট সামলে তিনি ফিরেছিলেন চট্টগ্রাম আবাহনীতে। চলতি মৌসুমেও এই দলে খেলার কথা ছিল তার। তবে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চট্টগ্রাম আবাহনী ভালো দল গড়ার পথ থেকে সরে এলে রানা যোগ দেন ব্রাদার্সে। সেখানে খেলেছেন অধিনায়ক হিসেবে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে কোনো দলগত অর্জন নেই রানার। ঘরোয়া ফুটবলেও কখনো লিগ শিরোপার স্বাদ পাননি। বিদায়বেলায় এই অপ্রাপ্তি সঙ্গী হচ্ছে তার, ‘আমার বড় আক্ষেপের জায়গা হলো দেশকে কিছু দিতে না পারা। দেশের মানুষ যেভাবে ফুটবলকে ভালোবাসে, যেভাবে মনের মধ্যে লালন করে, ওইভাবে ফুটবলকে আমরা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। সোনালি প্রজন্মের তারকা যেমন ছাঈদ হাছান কানন ভাই, আমিনুল ভাই, সাব্বির ভাই, আসলাম ভাই এদের নাম যেভাবে মানুষ সবসময় মুখে মুখে বলেন, সেভাবে আমরা তাদের মতো করে কেউ হতে পারিনি। এটা আমার আক্ষেপের। আর বড় ক্লাবে খেললেও কখনো লিগ শিরোপার স্বাদ পাইনি। একাধিকবার রানার্সআপ দলের সদস্য ছিলাম। তবে কাক্সিক্ষত শিরোপা ছুঁয়ে দেখিনি।’
ফুটবল খেলা ছাড়লেও ফুটবলকে একেবারে ছাড়বেন না রানা। এএফসি বি কোচিং লাইসেন্স নিয়েছেন গোলকিপিংয়ের ওপর বিশেষায়িত কোর্স করে কাজ করতে চান দেশের ফুটবলে, ‘আমার ইচ্ছা গোলকিপিং কোচিংয়ে আসার। ফুটবল আমাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, এটাকে ছাড়তে পারব না। ফুটবলের সঙ্গে থেকে এর সেবা করতে চাই। পাশাপাশি কোনো একটা ব্যবসা হয়তো শুরু করব দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে।’
দুই সন্তানের জনক রানা ফুটবল ছাড়ছেন আগামীর কাছে স্বপ্নের ব্যাটনটা তুলে দিয়ে। নিজে যা পাননি, সেই সাফল্য যেন বর্তমান প্রজন্মের হাতে ধরা দেয় বিদায়বেলায় এটাই কামনা।