স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) সম্প্রতি প্রকাশিত তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলেছে, বিশ্ব ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে এবং পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা বাড়ছে। এই প্রতিবেদনে সংঘাত, অস্ত্র সরবরাহ এবং সামরিক ব্যয়ের ওপর গবেষণার পাশাপাশি বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে ৯টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া এবং ইসরায়েলের মধ্যে নতুন একটি পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার উত্থানের ওপর। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, যদিও পারমাণবিক ওয়ারহেডের সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পাচ্ছে, তবুও নতুন ওয়ারহেড তৈরি এবং অস্ত্রের আধুনিকীকরণের ফলে বিশ^ একটি নতুন পারমাণবিক যুগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এসআইপিআরআইয়ের প্রতিবেদন অনুসারে, পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো তাদের অস্ত্রভাণ্ডার আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। চীন উত্তরাঞ্চলের মরুভূমি ও পাহাড়ি এলাকায় ৩৫০টি নতুন লঞ্চ সাইলো নির্মাণ করছে এবং গত এক বছরে ১০০টি নতুন ওয়ারহেড তৈরি করে তাদের মজুদ ৬০০-এ উন্নীত করেছে। এই সম্প্রসারণের গতি অব্যাহত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও চীনের নীতি হলো প্রথমে পারমাণবিক হামলা না চালানো, তবে তারা এখন ‘লঞ্চ-অন-ওয়ার্নিং’ ক্ষমতা তৈরি করছে বলে মনে করা হচ্ছে; যা একটি প্রতিরক্ষামূলক প্রতিশোধমূলক হামলার ক্ষমতা নির্দেশ করে।
ভারত এবং চীন উভয়ই এখন ক্রান্তিকালে মিসাইলের সঙ্গে ওয়ারহেড সংযুক্ত রাখার নীতি গ্রহণ করছে, যা তাদের দীর্ঘদিনের পৃথক রাখার নীতির পরিবর্তন। রাজনৈতিকভাবে ভারত ঐতিহ্যগতভাবে পাকিস্তানের দিকে অধিক মনোযোগী ছিল। এশিয়ার পরাশক্তি হয়ে ওঠার দৌড়ে দেশটি এখন সে ধারাতেও পরিবর্তন এনেছে। পাকিস্তানের পাশাপাশি এখন চীনের দিকেও দৃষ্টি দিয়ে দীর্ঘ পাল্লার মিসাইল তৈরি করছে ভারত। উত্তর কোরিয়া ৪০টি নতুন বোমা তৈরির জন্য পর্যাপ্ত ফিসাইল উপাদান পরিশোধন করেছে এবং এ সংখ্যা ৫০-এ উন্নীত করতে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানও ফিসাইল উপাদান মজুদ করছে এবং আগামী দশকে তাদের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার সম্প্রসারণের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে বলে বলা হয়েছে এসআইপিআরআইয়ের প্রতিবেদনে।
ইউরোপে, যুক্তরাজ্য তাদের ওয়ারহেডের সংখ্যা ২২৫ থেকে ২৬০-এ উন্নীত করছে এবং নতুন ড্রেডনট শ্রেণির পারমাণবিক সক্ষম সাবমেরিন নির্মাণ করছে। ফ্রান্স তৃতীয় প্রজন্মের সাবমেরিন এবং পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম ক্রুজ মিসাইল তৈরি করছে। ইসরায়েল তাদের বিদ্যমান সাবমেরিন থেকে পারমাণবিক মিসাইল নিক্ষেপের ক্ষমতা রাখে। তবে তাদের বহরে যুক্ত নতুন সাবমেরিন ‘ড্রাকন’-এ উল্লম্বভাবে লঞ্চ সিস্টেম যুক্ত করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর এই সাত দেশের কাছে মোট পরমাণুর অস্ত্রের মাত্র ১০ শতাংশ রয়েছে। বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্রের ৯০ শতাংশই রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। উভয় দেশই প্রায় ১ হাজার ৭০০টি ওয়ারহেড মোতায়েন করেছে এবং তাদের মজুদে আরও ৪ হাজার ৫২১টি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র গত বছর ২০০টি আধুনিকীকৃত ওয়ারহেড গ্রহণ করেছে, যা শীতল যুদ্ধের পর সর্বোচ্চ। রাশিয়াও তাদের বিমান ও সমুদ্রভিত্তিক বিতরণ ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ করছে এবং বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রাশিয়া তাদের পারমাণবিক নীতি প্রসারিত করেছে। আগে রাশিয়ার অস্তিত্ব বিপন্ন হলে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি ছিল। এখন রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব বা আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ‘গুরুতর হুমকি’ বা ‘বায়ু ও মহাকাশ হামলার ব্যাপক নিক্ষেপ’ হলেই তা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই ‘ব্যাপক নিক্ষেপে’র মধ্যে ইউক্রেনের ব্যবহৃত ড্রোন হামলাও পড়তে পারে। এসআইপিআরআইয়ের মতে, এই নতুন নীতি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রান্তিক কমিয়ে দিয়েছে, যা রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধে প্রচলিত অস্ত্রের দুর্বল কর্মক্ষমতার কারণে তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্রের এই সম্প্রসারণ ঘটছে বিশ্বে প্রচলিত সশস্ত্র সংঘাত তীব্রতর হওয়ার পটভূমিতে। এসআইপিআরআইয়ের হিসাবে, ২০২৩ সালে বিশ্বে সংঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৮৮,০০০, যা ২০২৪ সালে বেড়ে ২৩৯,০০০-এ পৌঁছেছে। এর মধ্যে রয়েছে ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট, মিয়ানমার ও সুদানের গৃহযুদ্ধ এবং ইথিওপিয়ার উগ্র জাতীয় সশস্ত্র সংঘাত।
বিশ^ব্যাপী সামরিক ব্যয় গত দশকে ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শুধু ২০২৪ সালে তা ৯ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এই বর্ধিত সামরিক ব্যয় এবং পারমাণবিক অস্ত্রের আধুনিকীকরণ বিশ্বকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলছে। ইউরোপে, বিশেষ করে নর্ডিক দেশগুলোয় পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে আলোচনা তীব্র হয়েছে। সুইডেন ও ডেনমার্কে ‘নর্ডিক বোমা’র ধারণা এখন সকালের রেডিও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। ডেনমার্কের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেপে কোফোড একটি নর্ডিক প্রতিরক্ষা ইউনিয়নের পক্ষে কথা বলেছেন, যার নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র থাকবে। এটি উল্লেখযোগ্য, কারণ ডেনমার্ক ও নরওয়ে ন্যাটোর পারমাণবিক উপস্থিতি তাদের ভূখণ্ডে সীমিত করেছিল। অঞ্চলটিতে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধের পক্ষে সোচ্চার হওয়ার ইতিহাস রয়েছে।
ফিনল্যান্ড ও সুইডেন গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের ভূখণ্ডে সৈন্য ও পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের অনুমতি দিয়েছে। পোল্যান্ডও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্র ভাগাভাগির জন্য উন্মুক্ততা প্রকাশ করেছে। বিশ্বের ১৯৩টি জাতিসংঘ সদস্যের মধ্যে ১৭৮টি দেশ কম্প্রিহেনসিভ নিউক্লিয়ার টেস্ট ব্যান ট্রিটি (সিটিবিটি) অনুমোদন করেছে। গত বছর চারটি দেশ পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি (টিটিএনডব্লিউ) অনুমোদন করেছে, যার মাধ্যমে এই চুক্তির মোট অনুমোদনকারী দেশের সংখ্যা ৭৩-এ পৌঁছেছে। আরও ২৫টি দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, তবে এখনো অনুমোদন করেনি। এসআইপিআরআইয়ের পরিচালক ড্যান স্মিথ বলেন, পারমাণবিক যুদ্ধে কেউ জয়ী হতে পারে না। তিনি উল্লেখ করেন, পারমাণবিক যুগের ৮০ বছর পরও কোনো পরিস্থিতিতে পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করা সম্পূর্ণ অর্থহীন। তিনি ইসরায়েলের উদাহরণ দিয়ে বলেন, যদি ইসরায়েল গুরুতর অস্তিত্বের হুমকির মুখে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে, তবে তা তাদের রক্ষা করবে না, বরং সর্বোচ্চ প্রতিশোধ হিসেবে কাজ করবে।
এসআইপিআরআইয়ের প্রতিবেদন বিশ্বের ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতা এবং পারমাণবিক অস্ত্রের সম্প্রসারণের ঝুঁকির ওপর আলোকপাত করেছে। পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর অস্ত্র আধুনিকীকরণ, নীতি পরিবর্তন এবং বিশ্বব্যাপী সংঘাতের তীব্রতা একটি নতুন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার আশঙ্কা তৈরি করছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ এবং অপসারণের প্রচেষ্টা জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার জরুরি বৈঠক
ইরান-ইসরায়েলের চলমান সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে বৃহৎ পরিসরে যুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি দুই দেশের পারমাণবিক সক্ষমতা এই উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গতকাল সোমবার জরুরি বৈঠক ডাকে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। বিশেষ এই বৈঠকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় ইসরায়েলের হামলা নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। এর আগে শুক্রবার আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রধান রাফায়েল গ্রোসি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে জানান, ইসরায়েল ইরানের ইসফাহান ও ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনা এবং নাতাঞ্জের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। তবে আইএইএ জানিয়েছে, গত শুক্রবারের ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ইসরায়েল গতকালও ইরানের গভীরে হামলা চালানোর ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট করে কোথায় হামলা চালানো হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়নি।
তবে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার সাবেক উপপরিচালক জেনারেল ফর সেফগার্ডস অলি হেইনোনেনের মত ভিন্ন। তিনি মনে করেন, ইসরায়েলের হামলার পর ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোর সক্ষমতা পুনরুদ্ধারে খানিকটা সময় লাগবে তেহরানের। তবে একই সঙ্গে ইরান তাদের ৪০০ কিলোগ্রামের বেশি উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম কোথায় সংরক্ষণ করছে; সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। হেইনোনেন তিবলেন, যদি তাদের কোনো গোপন আস্তানা থাকে, যা খুব বড় হতে হবে এমনটা না... এবং তারা গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর মতো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারে, যেখানে আইএইএর নজরদারি নেই, তাহলে আমাদের বড় সমস্যা হয়ে যাবে।