অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম : অন্তিম শ্রদ্ধা
মুহম্মদ নূরুল হুদা | ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০
সমকালীন বাংলাদেশের স্বারশত সমাজে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম একজন অগ্রগণ্য মানুষ হিসেবেই বিবেচিত ছিলেন। প্রায় ৮৭ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। এর ফলে আমাদের সমাজে যে ক্ষতি হলো তা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। কারণ প্রফেসর রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, তারও আগে ভাষা সংগ্রাম, আমাদের সংস্কৃতির যে সংগ্রাম তার একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি। তিনি আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনে একজন প্রধানতম পুরুষ ছিলেন। তিনি শাশ্বত সমাজের সদস্য হিসেবে, সংগঠক হিসেবে, একজন সংস্কৃতির অগ্রগণ্য পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে আমাদের কাছ থেকে সম্মানীয় হিসেবেই থাকবেন।
আমি তার সাথে পরিচিত হয়েছিলাম ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যখন আমি ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই, তার মধ্য দিয়ে। একেবারেই তরুণ বয়সে আমার সাথে তার পরিচয় ঘটে। ইংরেজি আমার মূল বিষয় হলেও আমার সাবসিডিয়ারি বিষয় ছিল বাংলা। সেই বাংলা ক্লাসেই তাকে আমি শিক্ষক হিসেবে পাই। সেই সময়ে আমি তরুণ শিক্ষক রফিকুল ইসলামকে পেয়েছিলাম। তিনি আমাদের নাটক পড়াতেন। তার সঙ্গে আরো যে সকল বাংলার শিক্ষককে পেয়েছিলাম স্যার আহমদ শরীফ, প্রফেসর নীলিমা ইব্রাহিম, প্রফেসর আনিসুজ্জামান। তারা ছাড়াও আরো অনেক গুণী অধ্যাপক ছিলেন।
রফিক স্যার শুরুতেই আমাদের দৃষ্টি করেছিলেন এই কারণে যে, তিনি খুবই সীমিত উচ্চারণে পাঠ্য বই থেকে পড়ে আমাদের বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিতেন। অধ্যাপকদের মতো বক্তৃতা দিয়েই তিনি কাজ শেষ করতেন না। তিনি নিজে কবিতা না লিখলেও কবিতা সম্পাদনার সাথে জড়িত ছিলেন। শিল্প-সাহিত্যের সাথে তখন থেকেই তাঁকে সংযুক্ত থাকতে দেখেছিলাম। সেই সময়ে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত একটি কবিতা সংকলনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন সেই সংকলনের অন্যতম সম্পাদক। আমি যেহেতু কবিতা লিখতাম, কবিতার সূত্রেই তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। সেই থেকে শুরু করে শেষ অব্দি আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক অক্ষুন্ন ছিল। সর্বশেষ আমি তাকে পেয়েছিলাম বাংলা একাডেমির সভাপতি হিসেবে, যেই মুহূর্তে আমি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। এর আগে যেখানে ছিলেন অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান এবং আনিসুজ্জামান স্যার। আমাদের একটি আফসোসের বিষয় হলো এই তিনি সভাপতি হিসেবে বাংলা একাডেমিতে যোগ দিয়েছিলেন কভিডের সময়ে। এই মহামারীর সময়ে যখন চলাচল থেকে শুরু করে সবকিছু সীমিত হয়ে পড়েছিল, এই সময়ে তাকে আমরা শারীরিকভাবে পাইনি। তার পরেও যেভাবে যতটুকু পেয়েছি তার পরামর্শ ও নির্দেশনায় কাজ করেছি। তার সঙ্গে মোবাইল-ইন্টারনেটে যোগাযোগ রেখে চলেছি। বিশেষ করে, আমরা জুম মিটিং এর মাধ্যমে একাডেমির গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেছি। একাডেমিতে যেকোনো প্রয়োজনে সহযোগিতামূলক অনুপ্রেরণামূলক কাজে তাকে পেয়েছি। প্রায় প্রতিদিনই তার সাথে একাডেমির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরামর্শ করেছি, কথা বলেছি। তিনি অসুস্থ হওয়ার পরেও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে, তার ছেলে এবং মেয়ের সাথে যোগাযোগ রেখেছি, তার খোঁজখবর নিয়েছি।
এসবই ব্যক্তিগত বিষয়। এর বাইরে যদি একাডেমিক কিংবা বাইরের অন্য বিষয়ে আলোকপাত করি অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম একজন আন্তর্জাতিক মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়াশোনা করেছেন, অধ্যাপনা করেছেন। ষাটের দশকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। এরপর তিনি দেশের বাইরে আমেরিকায় পড়াশোনা করতে গান যান। সেখান থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবেও তার অবদান উল্লেখযোগ্য। তিনি লেখাপড়া করেছেন ভাষা নিয়ে, গবেষণা করেছেন। আমাদের সমাজে একজন অগ্রসর মানুষ হিসেবেই বিবেচিত হতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভাষাবিজ্ঞান পড়াতেন। এরই মধ্যে তিনি তিনি জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম সম্পর্কে উৎসাহী হন এবং সর্বপ্রথম বাংলাদেশে নজরুল নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। সেই যে কাজী নজরুলের সাথে তার সম্পর্ক শুরু হলো শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন নজরুলের সবচেয়ে বড় সমালোচক ও গবেষক। নজরুলের কাজটি তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে কাজ করেছেন। নজরুলের কাজের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যাকার ও বিশ্লেষক হিসেবেও তিনি উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবেন। আমি বলব অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, কাজী নজরুল ইসলাম এবং জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ঐক্য গড়ে উঠেছিল।
কাজী নজরুল ছিলেন আন্তর্জাতিকতাবাদী, একইসাথে জাতীয়তাবাদী। সারা বিশ্বের মানুষের জন্য মানবতাবাদি কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বঙ্গবন্ধু দেশে এনেছিলেন। রফিক স্যার তাকে নিয়ে কাজ করেছিলেন। নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তেমনি শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। নজরুল ইসলাম তার কবিতায় প্রবন্ধে অসম্প্রদায়িকতার কথা বলেছেন, গানে গানে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেছিলেন। নজরুল তার প্রবন্ধ উপমহাদেশের স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। আমরা দেখেছি, ১৯৪৭ এ দেশ ভাগ হয়েছিল। তার ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা দূর হয়নি। যার ফলশ্রুতিতে আমরা পরবর্তীতে দেখি ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, বাঙালির ভাষার লড়াই সংস্কৃতি রক্ষার লড়াইয়ে পরিণত হয়। স্বাধীকারের যুদ্ধ ধীরে ধীরে আমরা স্বাধীনতার যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাই।
এই পুরোটা সময় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর এই যাত্রায় একজন আদর্শের অনুসারী ছিলেন। সার্বভৌমত্বের যেই আকাক্সক্ষা তার সাথে জড়িত ছিলেন। আমরা জানি, তিনি সেই তরুণ বয়সেই ভাষা আন্দোলনের যেই চিত্ররূপ তার ক্যামেরায় তুলে ধরেছিলেন তা আমাদের ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছে। তিনি পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করেছেন। তাই তার হাত ধরে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস হয়ে উঠেছে জীবন্ত। তিনি ভাষা বিজ্ঞানী থেকে ভাষাসংগ্রামী এবং ইতিহাসবিদে পরিণত হয়েছেন।
স্বাধীন রাষ্ট্র এবং জাতিসত্তা এবং ভাষা সত্তার মূল ব্যাখ্যাকার হিসেবে যাদের মূল্যায়ন করি তিনি তাদের একজন হয়ে আছেন, অন্যতম একজন হয়ে আছেন। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার ছাত্রী ছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বিকাশ এবং এসবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যেই রূপকল্প তৈরি করা হয়েছে তিনি তাদের একজন ছিলেন। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম দেশে-বিদেশে বেশ সমাদৃত ছিলেন। এর মধ্যে অনেকগুলো কারণ ছিল। তবে আমি যেটি বলবো প্রধানতম কারণ ছিল কাজী নজরুলকে নিয়ে তার গবেষণা ও ব্যাখ্যা। নজরুলের কাজ তাকে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল।
বর্তমানে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজী নজরুলকে নিয়ে কাজ হচ্ছে। এছাড়া নজরুলকে নিয়ে নানাবিধ আঙ্গিকে গবেষণা চলছে, বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নজরুল চেয়ার রয়েছে। নজরুল বিষয়ে গবেষণার জন্য একজন অধ্যাপক সেখানে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে করেন। এ সমস্ত কাজের সাথে অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের নিবির সংযোগ ছিল। এই করোনা মহামারী কালেও আমরা দেখেছি অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম অনলাইনে যুক্ত থেকে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা একই সাথে পালন করেছি। এখানেও অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত উদযাপন কমিটি হলে তিনি তার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা, বঙ্গবন্ধুর রচনা পাঠ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এখনকার প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে তিনি কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধু যে আদর্শ চেতনা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এখনকার বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে দেখা উচিত কীভাবে মূল্যায়ন করা উচিত তিনি সেই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিতেন। তিনি জীবন শুরু করেছিলেন একজন একাডেমিক লোক হিসেবে, ভাষাতাত্ত্বিক হিসেবে। আবার পরের দিকে যখন গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি পাকিস্তানি সেনা কর্র্তৃক নির্যাতিত হয়েছিলেন, নিপীড়ন সহ্য করেছেন, শারীরিকভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তার সত্বেও তিনি দেশের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছেন, বীরের মতো দেশের পক্ষ অবলম্বন করেছেন। তিনি একজন অনুকরণীয় ব্যক্তি হিসেবে আমাদের কাছে পরিগণিত হয়ে থাকবেন। তাকে আমরা অন্তিম অভিবাদন ও শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : কবি। মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি
শেয়ার করুন
মুহম্মদ নূরুল হুদা | ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০

সমকালীন বাংলাদেশের স্বারশত সমাজে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম একজন অগ্রগণ্য মানুষ হিসেবেই বিবেচিত ছিলেন। প্রায় ৮৭ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। এর ফলে আমাদের সমাজে যে ক্ষতি হলো তা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। কারণ প্রফেসর রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, তারও আগে ভাষা সংগ্রাম, আমাদের সংস্কৃতির যে সংগ্রাম তার একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি। তিনি আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনে একজন প্রধানতম পুরুষ ছিলেন। তিনি শাশ্বত সমাজের সদস্য হিসেবে, সংগঠক হিসেবে, একজন সংস্কৃতির অগ্রগণ্য পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে আমাদের কাছ থেকে সম্মানীয় হিসেবেই থাকবেন।
আমি তার সাথে পরিচিত হয়েছিলাম ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যখন আমি ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই, তার মধ্য দিয়ে। একেবারেই তরুণ বয়সে আমার সাথে তার পরিচয় ঘটে। ইংরেজি আমার মূল বিষয় হলেও আমার সাবসিডিয়ারি বিষয় ছিল বাংলা। সেই বাংলা ক্লাসেই তাকে আমি শিক্ষক হিসেবে পাই। সেই সময়ে আমি তরুণ শিক্ষক রফিকুল ইসলামকে পেয়েছিলাম। তিনি আমাদের নাটক পড়াতেন। তার সঙ্গে আরো যে সকল বাংলার শিক্ষককে পেয়েছিলাম স্যার আহমদ শরীফ, প্রফেসর নীলিমা ইব্রাহিম, প্রফেসর আনিসুজ্জামান। তারা ছাড়াও আরো অনেক গুণী অধ্যাপক ছিলেন।
রফিক স্যার শুরুতেই আমাদের দৃষ্টি করেছিলেন এই কারণে যে, তিনি খুবই সীমিত উচ্চারণে পাঠ্য বই থেকে পড়ে আমাদের বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিতেন। অধ্যাপকদের মতো বক্তৃতা দিয়েই তিনি কাজ শেষ করতেন না। তিনি নিজে কবিতা না লিখলেও কবিতা সম্পাদনার সাথে জড়িত ছিলেন। শিল্প-সাহিত্যের সাথে তখন থেকেই তাঁকে সংযুক্ত থাকতে দেখেছিলাম। সেই সময়ে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত একটি কবিতা সংকলনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন সেই সংকলনের অন্যতম সম্পাদক। আমি যেহেতু কবিতা লিখতাম, কবিতার সূত্রেই তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। সেই থেকে শুরু করে শেষ অব্দি আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক অক্ষুন্ন ছিল। সর্বশেষ আমি তাকে পেয়েছিলাম বাংলা একাডেমির সভাপতি হিসেবে, যেই মুহূর্তে আমি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। এর আগে যেখানে ছিলেন অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান এবং আনিসুজ্জামান স্যার। আমাদের একটি আফসোসের বিষয় হলো এই তিনি সভাপতি হিসেবে বাংলা একাডেমিতে যোগ দিয়েছিলেন কভিডের সময়ে। এই মহামারীর সময়ে যখন চলাচল থেকে শুরু করে সবকিছু সীমিত হয়ে পড়েছিল, এই সময়ে তাকে আমরা শারীরিকভাবে পাইনি। তার পরেও যেভাবে যতটুকু পেয়েছি তার পরামর্শ ও নির্দেশনায় কাজ করেছি। তার সঙ্গে মোবাইল-ইন্টারনেটে যোগাযোগ রেখে চলেছি। বিশেষ করে, আমরা জুম মিটিং এর মাধ্যমে একাডেমির গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেছি। একাডেমিতে যেকোনো প্রয়োজনে সহযোগিতামূলক অনুপ্রেরণামূলক কাজে তাকে পেয়েছি। প্রায় প্রতিদিনই তার সাথে একাডেমির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরামর্শ করেছি, কথা বলেছি। তিনি অসুস্থ হওয়ার পরেও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে, তার ছেলে এবং মেয়ের সাথে যোগাযোগ রেখেছি, তার খোঁজখবর নিয়েছি।
এসবই ব্যক্তিগত বিষয়। এর বাইরে যদি একাডেমিক কিংবা বাইরের অন্য বিষয়ে আলোকপাত করি অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম একজন আন্তর্জাতিক মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়াশোনা করেছেন, অধ্যাপনা করেছেন। ষাটের দশকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। এরপর তিনি দেশের বাইরে আমেরিকায় পড়াশোনা করতে গান যান। সেখান থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবেও তার অবদান উল্লেখযোগ্য। তিনি লেখাপড়া করেছেন ভাষা নিয়ে, গবেষণা করেছেন। আমাদের সমাজে একজন অগ্রসর মানুষ হিসেবেই বিবেচিত হতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভাষাবিজ্ঞান পড়াতেন। এরই মধ্যে তিনি তিনি জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম সম্পর্কে উৎসাহী হন এবং সর্বপ্রথম বাংলাদেশে নজরুল নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। সেই যে কাজী নজরুলের সাথে তার সম্পর্ক শুরু হলো শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন নজরুলের সবচেয়ে বড় সমালোচক ও গবেষক। নজরুলের কাজটি তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে কাজ করেছেন। নজরুলের কাজের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যাকার ও বিশ্লেষক হিসেবেও তিনি উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবেন। আমি বলব অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, কাজী নজরুল ইসলাম এবং জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ঐক্য গড়ে উঠেছিল।
কাজী নজরুল ছিলেন আন্তর্জাতিকতাবাদী, একইসাথে জাতীয়তাবাদী। সারা বিশ্বের মানুষের জন্য মানবতাবাদি কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বঙ্গবন্ধু দেশে এনেছিলেন। রফিক স্যার তাকে নিয়ে কাজ করেছিলেন। নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তেমনি শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। নজরুল ইসলাম তার কবিতায় প্রবন্ধে অসম্প্রদায়িকতার কথা বলেছেন, গানে গানে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেছিলেন। নজরুল তার প্রবন্ধ উপমহাদেশের স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। আমরা দেখেছি, ১৯৪৭ এ দেশ ভাগ হয়েছিল। তার ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা দূর হয়নি। যার ফলশ্রুতিতে আমরা পরবর্তীতে দেখি ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, বাঙালির ভাষার লড়াই সংস্কৃতি রক্ষার লড়াইয়ে পরিণত হয়। স্বাধীকারের যুদ্ধ ধীরে ধীরে আমরা স্বাধীনতার যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাই।
এই পুরোটা সময় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর এই যাত্রায় একজন আদর্শের অনুসারী ছিলেন। সার্বভৌমত্বের যেই আকাক্সক্ষা তার সাথে জড়িত ছিলেন। আমরা জানি, তিনি সেই তরুণ বয়সেই ভাষা আন্দোলনের যেই চিত্ররূপ তার ক্যামেরায় তুলে ধরেছিলেন তা আমাদের ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছে। তিনি পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করেছেন। তাই তার হাত ধরে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস হয়ে উঠেছে জীবন্ত। তিনি ভাষা বিজ্ঞানী থেকে ভাষাসংগ্রামী এবং ইতিহাসবিদে পরিণত হয়েছেন।
স্বাধীন রাষ্ট্র এবং জাতিসত্তা এবং ভাষা সত্তার মূল ব্যাখ্যাকার হিসেবে যাদের মূল্যায়ন করি তিনি তাদের একজন হয়ে আছেন, অন্যতম একজন হয়ে আছেন। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার ছাত্রী ছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বিকাশ এবং এসবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যেই রূপকল্প তৈরি করা হয়েছে তিনি তাদের একজন ছিলেন। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম দেশে-বিদেশে বেশ সমাদৃত ছিলেন। এর মধ্যে অনেকগুলো কারণ ছিল। তবে আমি যেটি বলবো প্রধানতম কারণ ছিল কাজী নজরুলকে নিয়ে তার গবেষণা ও ব্যাখ্যা। নজরুলের কাজ তাকে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল।
বর্তমানে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজী নজরুলকে নিয়ে কাজ হচ্ছে। এছাড়া নজরুলকে নিয়ে নানাবিধ আঙ্গিকে গবেষণা চলছে, বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নজরুল চেয়ার রয়েছে। নজরুল বিষয়ে গবেষণার জন্য একজন অধ্যাপক সেখানে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে করেন। এ সমস্ত কাজের সাথে অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের নিবির সংযোগ ছিল। এই করোনা মহামারী কালেও আমরা দেখেছি অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম অনলাইনে যুক্ত থেকে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা একই সাথে পালন করেছি। এখানেও অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত উদযাপন কমিটি হলে তিনি তার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা, বঙ্গবন্ধুর রচনা পাঠ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এখনকার প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে তিনি কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধু যে আদর্শ চেতনা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এখনকার বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে দেখা উচিত কীভাবে মূল্যায়ন করা উচিত তিনি সেই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিতেন। তিনি জীবন শুরু করেছিলেন একজন একাডেমিক লোক হিসেবে, ভাষাতাত্ত্বিক হিসেবে। আবার পরের দিকে যখন গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি পাকিস্তানি সেনা কর্র্তৃক নির্যাতিত হয়েছিলেন, নিপীড়ন সহ্য করেছেন, শারীরিকভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তার সত্বেও তিনি দেশের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছেন, বীরের মতো দেশের পক্ষ অবলম্বন করেছেন। তিনি একজন অনুকরণীয় ব্যক্তি হিসেবে আমাদের কাছে পরিগণিত হয়ে থাকবেন। তাকে আমরা অন্তিম অভিবাদন ও শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : কবি। মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি