
প্রশ্ন হচ্ছে, মার্কিন ভিসানীতি বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে? এক্ষেত্রে কতগুলো জিনিস দেখা দরকার। একটা হলো মার্কিন ভিসা রেস্ট্রিকশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম না। তারা বেশ কতগুলো দেশের ওপর ভিসা রেস্ট্রিকশন বিভিন্ন সময়ে দিয়েছে। তাতে সেই দেশের রাজনীতি ও পরিস্থিতির যে খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে সেটা বলা মুশকিল। আমাদের পাশের দেশ মিয়ানমারের ওপরও এরকম রেস্ট্রিকশন আছে, তাতে যে দেশটির কোনো পরিবর্তন হয়েছে সেটা দেখা যায় না। ঠিক একইভাবে অনেক দেশ আছে যেখানে হয়তো গণতন্ত্রের কাঠামো খুবই দুর্বল। যেমন, পাকিস্তানের কথা ধরা যেতে পারে। কিন্তু সেসব দেশের বেলায় আমরা এ ধরনের রেস্ট্রিকশন দেখি না। অন্যকথায়, এটা তারা যে খুব চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে এটা করেই তা আমার কখনই মনে হয়নি। কারণ, মনে রাখতে হবে, যেকোনো দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের যে বিষয় সেখানে ন্যূনতম কতগুলো বিষয় বা শর্ত থাকতে হয়। গণতন্ত্র নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম ডেফিসিট বা ঘাটতি বিভিন্নভাবে আছে। কোনো সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের এক ধরনের ঘাটতি আছে। আবার অন্য দেশে সেই ঘাটতিটা অন্য ধরনের। কথা হচ্ছে, সেটা বাইরের একটা ফোর্স এসে কি সমাধান করতে পারবে? আজ আমেরিকার গণতন্ত্রের যে ঝামেলা সেটা কি বাইরের কোনো শক্তি তার সমাধান করতে পারবে? আমার মনে হয় না। এটা ওই দেশের জনগণকেই সমাধান করতে হবে। এখন ন্যূনতম শর্ত যেটা, সেটা বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেন আস্থা থাকে। পশ্চিমা কাঠামোতে যেই নির্বাচনের কথা বলা হয়, আমাদের দেশেও যেহেতু ব্রিটিশদের হাত ধরে সেটা এসেছে; সেখানে বড় বড় পার্টিগুলোর মধ্যে আস্থা থাকতে হবে। দেশের বড় বড় দলগুলোর নিজেদের মধ্যে কোনো আস্থা নেই।
আমেরিকা এই যে ভিসা রেস্ট্রিকশনটা দিল, এতে কি আস্থা বাড়বে নাকি বিভাজন বাড়বে? খুব সহজে এর উত্তর হলো এখানে আস্থাটা বাড়বে না, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে বিভাজনটা আছে সেটাই আরও বাড়বে। তাহলে যেই গণতন্ত্রের কথা চিন্তা করা হচ্ছে সেখানে এই বিভাজনটা যদি বাড়ে, তাহলে তো আর সেই গণতন্ত্রটা আর হয় না। তাহলে এই বিভাজন যে তারা বাড়াচ্ছে এর কারণটা কী? এটা কি তারা জেনেশুনেই বাড়াচ্ছে? ব্যবসায়িক স্বার্থ থেকে শুরু করে জিও-পলিটিক্যাল স্বার্থ, এসব পূরণেই কি ভিসানীতি বা বিভিন্ন স্যাংশন, রেস্ট্রিকশন? অনেক দেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক আছে যেখানে গণতন্ত্রের অভাব আছে।
এখন আমেরিকার ভিসানীতি ঘোষণার বড় দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। নেতাকর্মীরা নানা ধরনের কথাবার্তা বলছেন। এগুলো হচ্ছে রাজনীতির কথা। কিন্তু আমি ওই রাজনীতির আলাপে যেতে চাই না। অ্যাকাডেমিশিয়ান হিসেবে আমি মনে করি না, দেশের বড় দুই দল এই মার্কিন ভিসানীতির কারণে নিজেদের মধ্যে ওই আস্থার জায়গায় আসছে বা আসবে। বিরোধী দল মনে করছে বা বলার চেষ্টা করছে যে সরকারি বা ক্ষমতাসীন দলের ওপর প্রেশার দেওয়া হয়েছে। আর ক্ষমতাসীন দল বলতে চাচ্ছে যে, আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন করব কিন্তু বিরোধী দল যেন সেখানে বাধা দিতে না পারে। আবার সরকারি দলের অনেকে এটাও মনে করছে যে, যেহেতু কেয়ারটেকার সরকারের কথা ভিসানীতিতে বলা হয়নি সেহেতু আমেরিকাও বুঝে ফেলেছে যে এই সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। এবং ইলেকশন কমিশনকে এখন দেখাতে হবে যে এটা স্বচ্ছ নির্বাচন হলো কি না। সেক্ষেত্রে বিভাজন বাড়ানোর যেই রাজনীতি সেটাই চোখে পড়ছে। শেষ বিচারে বাংলাদেশের গণতন্ত্রে যেই দুর্বলতা আছে সেটা যদি ঠিক করতে হয় ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে যে আমাদের দেশে তেমন পলিটিক্যাল স্ট্যাবিলিটি কিন্তু সেভাবে কখনই ছিল না, যেটা এবার হয়েছে বা ২০০৯ থেকে যদি বলি সেটা একটা রেজিম স্ট্যাবিলিটি হয়েছে, এটাও কিন্তু পার্থক্যকরণের দরকার। পলিটিক্যাল স্ট্যাবিলিটি বাংলাদেশে কখনই ছিল না, এই রেজিম স্ট্যাবিলিটি বা একটি গোষ্ঠীতন্ত্রের স্থিতিশীলতায় যেটা হয় উন্নয়নের কাঠামোটা করা সম্ভবপর হয়। রেজিম স্ট্যাবিলিটির কারণে উন্নয়নের একটা কাঠামো করা গেছে। ফলে বাংলাদেশের প্রতি অনেকের আকর্ষণ বেড়েছে। অনেকে মনে করছে, উন্নয়নের ব্যাপারে বাংলাদেশের একটা প্রমিস আছে। পলিটিক্যাল আনস্ট্যাবিলিটি সত্ত্বেও রেজিম স্ট্যাবিলিটি থাকার ফলে উন্নয়নের যে কাঠামো বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে তাতে অনেক দেশই মনে করে এখানে উন্নয়ন সম্ভাবনা রয়েছে। এটা বিশ^ব্যাংকও মনে করে, আইএমএফও মনে করে। এবং সেই হিসেবে চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ মনে করে। কথা হচ্ছে যে এই জিনিসটাকে ধরে রাখার বিষয়। আমাদের এমন সময় এটা ধরে রাখতে হবে যখন গোটা পৃথিবীতেই একটা বড় পরিবর্তন আসছে বা ঘটছে। সেটা হলো এককেন্দ্রিক বিশ^ থেকে বহুকেন্দ্রিক বিশ^ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে পৃথিবী।
বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমেরিকা যে ভিসানীতি দিয়েছে, সেখানে পুলিশ প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদের কথাও বলা হয়েছে। এর ফলে নির্বাচন বা সুষ্ঠু ভোটের পক্ষে প্রভাব পড়বে কি না। আমার কথা হচ্ছে, কোনো প্রভাবই পড়বে না। ধরলাম কারও কারও ছেলেমেয়ে আমেরিকায় থাকে, আমেরিকায় যাওয়াটা তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কথা হচ্ছে যে সে যদি ক্ষমতায়ই না থাকে তাহলে আমেরিকা যাওয়া না যাওয়ার কী আছে! আমাদের তো সবকিছুতেই বিভাজন হয়ে গিয়েছে। এটা কেবল রাজনীতিবিদদের মধ্যে না। ধারণা করা হয়, রাজনীতিবিদ ছাড়া অন্য পেশাজীবী যারা অবৈধ সম্পদ আহরণ করেছেন, আত্মীয়দের বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন তারা আসলে একটা সেফ এক্সিট চান। কিন্তু এটা এত সহজ না। ক্ষমতা চলে গেলে তো সে এমনিতেই সমস্যায় পড়বে। প্রশ্ন উঠতে পারে, যারা মানি লন্ডারিং করছে তাদের সেফ প্যাসেজ দিতেই এসব ভিসানীতি, রেস্ট্রিকশন কিনা। কথা সেটা না, কথা হচ্ছে যারা ক্ষমতার অবৈধ বা অনৈতিক চর্চা করছে সে তো এমনিতেই বড় প্রেশারে আছে। কারণ ক্ষমতা চলে গেলে কী হবে সেটা তার বড় চিন্তার বিষয়। এখন আমরা তো দেখছি যে নানা রকম মামলা, গ্রেপ্তার, আইনি প্রক্রিয়ায় পড়ে বিরোধীদের কী নাজেহাল অবস্থা। তখন তো সে এসবের মধ্যে পড়বে। ফলে তারা ক্ষমতাটা ধরেই রাখতে চাইবে। রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে যেমন, পেশাজীবীদের মধ্যেও তেমন। ক্ষমতাটা কেউ আসলে ছাড়তে চায় না। এটা আমি পলিটিক্যাল সায়েন্টিস্ট হিসেবে বলছি, এটা অনেকেই বুঝতে চায় না।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের একটা বড় ভূমিকা থাকে। এখানে গণতন্ত্র নিয়ে যতগুলো পরিবর্তন হয়েছে সেগুলো কিন্তু জনগণই করেছে। সেই জনগণের ওপর আস্থা রাখতেই হবে। বাইরের কোনো শক্তি ভিসা রেস্ট্রিকশন দিয়ে বা স্যাংশন দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ঠিক করে দেবে, এটা সম্ভব না। আমি মনে করি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পলিটিক্যাল পার্টি বা সিভিল সোসাইটির যদি ইচ্ছা থাকে, তাহলে তাদের জনগণের কাছেই যেতে হবে। এখন জনগণ কী চাচ্ছে সেটা যদি আমরা না দেখি তাহলে কিন্তু আমরা বুঝতে পারব না যে জনগণ কখন আন্দোলন করে বা কখন করে না। কেউ যদি বলে কাঠামোটা অনেক কঠিন হয়ে গেছে তাই চাইলেও জনগণ আন্দোলনে নামতে পারছে না, সেটাও ঠিক না। কারণ আমারা তো এর চেয়ে বড় সিচুয়েশন ফেস করেছি, মার্শাল ল’ দেখেছি। বিভিন্ন কাঠামো ভাঙতে জনগণ যে বাসায় বসে ছিল তা তো নয়। আমাদের যেটা বোঝা দরকার, আমরা যেভাবে গণতন্ত্রকে ডিফাইন করি সব মানুষ তো আর একভাবে গণতন্ত্রকে দেখে না। জরিপেও দেখা গেছে গণতন্ত্র বলতে তারা যতটা না নির্বাচন বোঝে, বাংলাদেশের জন্য ৫৪ শতাংশের বেশি মনে করে খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, বস্ত্রকে মানে বেসিক নেসেসিটিকে বড় মনে করে। ওই জরিপে মাত্র ১১ শতাংশ নির্বাচনকে বড় মনে করেছে। এই ১১ শতাংশের মধ্যে আবার এলিট বেশি, জনগণ কম। এর স্পষ্ট উদাহরণ হলো শ্রীলঙ্কা। দেশটির নির্বাচন নিয়ে কিন্তু কোনো প্রশ্ন করে না কেউ। ছোট দেশ, নির্বাচনও স্বচ্ছই হয়। কিন্তু তারপরও আমরা দেখেছি সেখানে পার্লামেন্টে পাবলিক অ্যাটাক করেছে, প্রেসিডেন্টের বাসায় আগুন দিয়েছে। কেন হয়েছে? কারণ দেশটির ইকোনমি যেভাবে ধসে পড়েছিল তাতে মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ভিসা রেস্ট্রিকশন দিয়ে কি এটা করা যাবে? বা স্যাংশন? আমেরিকায় আমাদের যে মার্কেট, গার্মেন্টস প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে, এটা তারা দয়া দেখিয়ে করেনি। মনে রাখতে হবে এটা একটা ক্যাপিটালিস্ট বিশ^। সেই প্রিন্সিপাল মেনেই সেখানে আমাদের মার্কেট হয়েছে। ভারত, চীন, ভিয়েতনামের থেকে আমদানির চাইতে বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিলে তাদের প্রফিট বেশি, বিষয়টা খুবই পরিষ্কার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এই যে বার্মা অ্যাক্ট করল আমেরিকা সেখানে তারা একসেপশন ক্লজ রেখেছে যে কোনোভাবেই বার্মার ইমপোর্ট থামানো যাবে না। কারণ, আমেরিকার ব্যবসায়ীদের স্বার্থ। সবশেষে যেটা বলতে চাই, আমেরিকার উদ্দেশ্য হয়তো সৎ আছে, যে তারা চায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী হোক। কিন্তু এই ভিসানীতি যেভাবে তারা দিয়েছে, সেখানে তেমন চিন্তাভাবনা তাদের ছিল বলে মনে হয় না। আর আমাদের যেটা করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন কমাতে হবে, আস্থা বাড়াতে হবে। এই বিভাজন রেখে বাংলাদেশে যেই গণতন্ত্রের কথা বলা হয় সেটা আসবে না। এখানে আমাদের যেমন নতুন চিন্তাভাবনার অভাব আছে, তেমনি বিদেশিরাও এই জায়গাতে ফোর্স করছে না। তাতে হচ্ছে কি, বিভাজনটা বাড়ছে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচনকে সামনে রেখে যে সম্প্রতি মার্কিন ভিসানীতি দেওয়া হয়েছে সেটাকে দুইভাবে দেখা যায়। এই যে ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্রকে সমর্থন বা সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন, এটার মধ্যেও একটা জিও-পলিটিক্যাল দিক আছে। সেটা কীরকম? একটা হলো তাত্ত্বিক পর্যায় থেকে দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিকভাবেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে আসছে। সেটা বিভিন্ন পর্যায়ে, বহুমাত্রিকভাবে। সেই সম্পর্কটা কিন্তু গত ৫২ বছরে ইতিবাচকভাবেই আবর্তিত হয়েছে। যেমন প্রথম দুই দশকের কথা যদি ধরি, সেই সম্পর্কটা ছিল মূলত এইড নির্ভর। ওই সময় বাইরে থেকে আমরা যে আর্থিক অনুদানগুলো পেতাম তার একটা বড় কন্ট্রিবিউটর বা অংশীদার ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা যে আর্থিক অনুদান দিত তার ভিত্তিতে আমরা আমাদের অর্থনীতিটা চালু রাখার চেষ্টা করতাম। আমাদের বাজেটও হতো সেভাবে। প্যারিস ক্লাবের পয়সা থেকেই তখন আমাদের বাজেট হতো। আমরা প্যারিসে গিয়ে জেনে আসতাম যে ডোনাররা কত দেবে, তার ভিত্তিতে আমরা বাজেট তৈরি করতাম। আর প্যারিস ক্লাবের সবচেয়ে বড় দাতা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের সবচেয়ে বড় ডোনারও তারা। স্বাধীনতার প্রথম দুই দশক এই নির্ভরতাটা ছিল। তার পরের ২০ বছরে দেখা যায় সম্পর্কটা বিবর্তিত হয়েছে। সেই এইড বা অনুদান নির্ভর সম্পর্ক থেকে এটা কিন্তু বাণিজ্যিক সম্পর্কে পরিবর্তিত হয়েছে। এই পর্যায়ে সম্পর্কটা লেনদেনের দিকে গেল। অর্থাৎ আগে আমরা একপাক্ষিকভাবে তাদের কাছ থেকে কেবল সাহায্য নিতাম পরে লেনদেনের বাণিজ্যিক সম্পর্কের দিকে গেলাম। এর মধ্য দিয়ে সম্পর্কেও একটা গুণগত পরিবর্তন হলো। বাংলাদেশের ৫২ বছরের হিসেবে এর পরের ১২ বছর যদি ধরি তাহলে এই সময়ে সম্পর্কটা কৌশলগত সহযোগিতার জায়গায় এসেছে। ২০১২ সালে আমাদের মধ্যে পলিটিক্যাল ডায়ালগ শুরু হয়েছে। সিকিউরিটি ডায়ালগ, ইকোনমিক ডায়ালগ হয়েছে। তখন থেকে এসব শুরুর পর এখন কাঠামোটা অনেক বেশি নিয়মতান্ত্রিক হয়েছে। একটা সম্মানজনক জায়গায় পারস্পরিক সহায়ক হিসেবে আমাদের সম্পর্কটা তৈরির দিকে এগিয়ে নিয়েছি। এর ফলে সম্পর্কে নতুন যে উপাদানগুলো যোগ হয়েছে বা প্রত্যাশাটা তৈরি হয়েছে সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ যেন গণতান্ত্রিক পথে যায়। আমরা একটা বড় জনগোষ্ঠীর দেশ, বঙ্গোপসাগরের পাশেই আমাদের অবস্থান। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটা সংযোগ স্থাপনের ভৌগোলিক অবস্থানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। ইত্যাদি বিবেচনায় বাংলাদেশ কৌশলগত গুরুত্বও তৈরি করেছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপিয়ান বা পশ্চিমা জগৎ এশিয়া অঞ্চলের ইতিবাচক অর্থনীতির অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে যখন বিশেষভাবে নজর দিচ্ছে। সেই মনোযোগের দিক থেকে আমরাও সেই বিশেষ মনোযোগের বা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছি। এই কারণেই বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেহারা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে ইতিবাচকভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, সন্ত্রাসবাদবিরোধী যেসব কর্মকা- হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে। আমেরিকার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটার মাত্রা এর মাধ্যমেই বোঝা যায়।
এবার যদি নতুন প্রেক্ষাপটে আসি। বাইডেন প্রশাসন আসার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আগের সেই সন্ত্রাসবাদবিরোধী গ্লোবাল ন্যারেটিভ থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন মার্কিন প্রশাসন তার অভ্যন্তরীণ কারণে, গত ৭/৮ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই গণতান্ত্রিক সংকট তৈরি হয়েছে। সেই সংকট থেকে উত্তরণের আলোকেই এখন অনেক কিছু হচ্ছে। তারা মনে করছে যে বাইরের পৃথিবীটাতেও যদি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী না করা যায় তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে বৈশ্বিক স্বার্থ আছে সেটা রক্ষা করা যাবে না। এখানে বৈশ্বিক স্বার্থ বলতে তাদেরই কৌশলগত স্বার্থের কথা বুঝিয়েছি। তারা একটা রুল বেজড গ্লোবাল অর্ডারের কথা বলে। সেখানে মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু থাকার কথা বলে। এগুলোর সবই তো আমাদের জন্যও ইতিবাচক। ভারত মহাসাগরে বা বঙ্গোপসাগরে যদি রুল বেজড মানে আইনের শাসন থাকে বা সমুদ্রপথটা যদি নির্বিঘ্ন হয় তাহলে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মার্কিন বর্তমান প্রশাসনের অন্যতম অগ্রাধিকার হলো গণতন্ত্র। বাইডেন প্রশাসন পরিষ্কার বলেছে, গণতান্ত্রিক বিশ্ব, অগণতান্ত্রিক বিশ্ব। তারা গণতান্ত্রিক বিশ্বটাকেই শক্তিশালী করতে কাজ করবে এটা তো ঘোষণাই করা হয়েছে। তারা নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্বের অন্য দেশগুলোতেও গণতন্ত্র যাতে শক্তিশালী হয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যেন চালু থাকে সে লক্ষ্যে সক্রিয় হয়েছে। কাজেই এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের এই দুটি মৌলিক বিষয়কে যদি আমরা দেখি তাহলেই বোঝা সম্ভব হবে যে এখানে কীভাবে আমরা কৌশলগত জায়গায় একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছি।
এখন ভূ-রাজনৈতিক জায়গার প্রসঙ্গে আসি। এ অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বন্ধু বাড়াতে চাইছে এটা যেমন সত্যি কথা তেমনি আমরা তো নিজেদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু বলেই মনে করি। সে ক্ষেত্রে তাদের যে পরিকল্পনা সেখানে কয়েকটা বিষয় আছে। একটা হচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি। অর্থাৎ এই ভারত মহাসাগর অঞ্চলকে ঘিরে তারা এখন বন্ধু বা একটা গণতান্ত্রিক বাতাবরণ তৈরি করতে আগ্রহী। এরও কারণ রয়েছে। তারা মনে করে চীন অগণতান্ত্রিক। কাজেই চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গেলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো আমার বন্ধু হিসেবে থাকলে মার্কিন অবস্থানটা শক্তিশালী হয়। এজন্য তারা চাইছে আমরা যেন আদর্শিকভাবে গণতন্ত্র চর্চার মধ্যে থাকি।
গণতন্ত্র কিন্তু শাসক দলের গণতন্ত্র না বা শাসনব্যবস্থার গণতন্ত্র না। গণতন্ত্রের মূল বক্তব্য হচ্ছে জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার। সেটাই হচ্ছে গণতন্ত্র। কাজেই সেই গণতন্ত্রের আলোকে জনগণই নির্ধারণ করবে কারা শাসন ক্ষমতায় থাকবে। এবং সেটা ঠিক করার প্রক্রিয়াটাই হচ্ছে নির্বাচন। যদি লক্ষ করি, গণতান্ত্রিক চর্চার কথা কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই বলছে না, অন্যরাও বলছে। আমাদের প্রতিবেশীরাও তাই-ই প্রত্যাশা করে। এখন এটা নিয়ে ভিসানীতি দেওয়াতে বা ব্লিঙ্কেন সাহেব কথা বলেছেন বলে আমাদের একটু খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া সবাই চায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা চালু থাকুক ও সেটা শক্তিশালী হোক। এর মধ্য দিয়ে মানুষের অধিকারের জায়গাটাও সাবলীল থাকুক। নিরাপদ থাকুক। বিশ্বের যে বড় বড় অর্থনীতি আছে যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আমাদের গার্মেন্টসের বড় চালান যায় সেখানে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সিঙ্গেল এক্সপোর্ট ডেস্টিনেশন। জাপান আমাদের এক নম্বর বাই ন্যাচারাল ডোনার। তারপর ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, জাতিসংঘের কথাও এক। জাতিসংঘ তো স্পষ্ট করেই গণতান্ত্রিক চর্চার কথা বলেছে। কাজেই লক্ষ করলেই বোঝা যাবে যে, এখানে একটা বৈশ্বিক আকর্ষণ বা অ্যাটেনশন যদি বলি, সেটা কিন্তু বাংলাদেশ পাচ্ছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা হোক মানুষ তার অধিকারটা পাক। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিটাও চালু থাকুক, নির্বিঘœ থাকুক। এসব নিয়ে দেশে-বিদেশে একটা সচেতনতা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ব্লিঙ্কেন সাহেব যেটা বলছিলেন যে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনটার দিকে বিশ্ব তাকিয়ে আছে। এই জায়গাটায় আমরা তার একটা ইঙ্গিত বা প্রতিফলন দেখতে পাই। আমরা সামগ্রিক অর্থে বিবেচনা করি তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র চর্চা, আগামী নির্বাচন, মানুষের অধিকারের মতো বিষয়গুলো যে শুধুমাত্র আমাদের জন্যই প্রয়োজন বা দরকার তা নয় কিন্তু। বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশকে অন্যরা কীরকম দেখতে চায় তারও একটা ইঙ্গিত রয়ে গেছে। এটা তো আমাদের জন্যও ইতিবাচক হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তো ইতিমধ্যেই বলেছে যে আমরা যদি জিএসপি প্লাস পেতে চাই তাহলে আগামী নির্বাচনটা তারা সুষ্ঠু দেখতে চায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সেটা দেখতে চায়। জাপানও তার প্রত্যাশার কথা বলেছে। আর চীন যে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু থাকুক সেটা চায় না, সেটা কিন্তু কখনই বলেনি। চীন চায় এমন একটা বাংলাদেশ যেটা স্থিতিশীল, অগ্রসরমাণ। কাজেই আমাদের বন্ধু বলেন আর উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র, তারা সবাই কিন্তু এই একটা ব্যাপারে সহমত বলে আমার মনে হয়েছে।
এক্ষেত্রে তাদের চাওয়া তো আছেই তার চেয়ে বড় তো আমাদের নিজেদের চাওয়া। সেটা হলো শান্তিপূর্ণভাবে, টেকসইভাবে আমাদের এই উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেজন্য সবচেয়ে উত্তম পথ হচ্ছে গণতান্ত্রিক চর্চাটাকে সাবলীল রাখা। তবে মার্কিন ভিসানীতির ক্ষেত্রে এখানে বাংলাদেশের দিক থেকে চীন-রাশিয়ার দিকে খানিকটা ঝুঁকে থাকার প্রবণতার বিষয়টির কথা অনেকে বলতে পারেন। তা খানিকটা থাকলেও আমি মনে করি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকলে অটোমেটিক্যালি ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু হয়ে যাব। স্থিতিশীলতার জন্যও এটা দরকার। শ্রীলঙ্কার উদাহরণই যথেষ্ট। দেশটির পরিস্থিতির জন্য পুরোটা না হলেও চীনা ঋণের একটা ভূমিকা আছে। চীনা সহায়তার প্রশ্নে পাকিস্তানেরও প্রায় একই অবস্থা। তারা এখন আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে চেষ্টা করছে। তাদের দৃষ্টিতে চায়না একটা সমস্যা। তাই এই দেশগুলো যাতে সেদিকে না যায় সেজন্য একটা কৌশলগত জায়গা পশ্চিমাদের থাকতে পারে। কিন্তু তাদের এই কনসার্ননেস বা সহায়তার উপাদানটা কাজে লাগবে না, যদি দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক না থাকে।
ঢাকার অদূরে সবুজে ঘেরা, শহরের কোলাহল ও ট্রাফিকমুক্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দেশের মানুষ দেশের একমাত্র ‘সম্পূর্ণ আবাসিক’ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেই চেনে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ, এমনকি দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য হল প্রশাসন একটি সিটের ব্যবস্থা করতে পারে না। যে অসীম সম্ভাবনাময়ী ও আত্মপ্রত্যয়ী বয়সে শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার গঠন করার কথা, তখন তাদের গণরুম নামক এক ‘নরকে’ টিকে থাকার লড়াই করতে হয়। লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে, হাজারো মেধাবী শিক্ষার্থীকে বেছে নিয়ে কীভাবে তাদের মেধা ও সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুম নামক ‘নরকের’ বিলুপ্তি, অছাত্রদের হল থেকে বের করে দেওয়া ও নিয়মিত শিক্ষার্থীদের আবাসন নিশ্চিতের দাবিতে গত চারদিন ধরে ‘প্রত্যয়’ নামের একজন শিক্ষার্থী হলের বাইরে মাঠে অবস্থান করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছরের একটি স্নাতক সম্পন্ন করতে যান। অথচ তার স্নাতক কোর্সের অর্ধেক সমাপ্ত হওয়ার সময়ে তাকে হলে একটি সিটের দাবিতে খোলা আকাশের নিচে রাত-দিন অবস্থান করতে হচ্ছে। এই সময়ে প্রত্যয়ের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত তরুণ ও শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে জার্নাল লেখার কথা কিন্তু দেশের একমাত্র ‘আবাসিক’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েও তাকে হলে থাকার ন্যূনতম আবাসনের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীর দাবি যৌক্তিক, কিন্তু বাস্তবায়নে সময় লাগবে’। ভিসি মহোদয়ের বক্তব্যে আমার ন্যূনতম আস্থা নেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর পড়ালেখা করেছি। চার বছর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় দৈনিকে সাংবাদিকতা করেছি। একটি বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে ফাংশান করে, খুব কাছ থেকে দেখেছি। ভিসি আসে ভিসি যায়। প্রভোস্ট আসে, যায়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটের সমাধান আসে না। প্রতি বছর নতুন ব্যাচ আসার আগে হল প্রশাসন ‘অছাত্রদের হল ছাড়তে’ বলে নিয়ম রক্ষার একটি নোটিস সাঁটান। তাদের দৌরাত্ম্য অতটুকুই। হল প্রশাসনের অছাত্রদের হল থেকে বের করার ইচ্ছে বা সাহস নেই। হল ছাড়া কেন, শিক্ষার্থীদের হলের সিট বণ্টনেও হল প্রশাসনের ন্যূনতম প্রভাব নেই। এমনকি কোনো হল প্রভোস্ট বলতে পারবেন না, তার হলে কতজন ছাত্র ও কতজন অছাত্র অবস্থান করছেন! আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুম বিলুপ্তি করে নিয়মিত ছাত্রদের সিট বণ্টনের দাবি করেছিলাম, তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জবাব ছিল ‘নতুন হল হলেই আবাসন সমস্যার সমাধান হবে’।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর হলের সিট সাপেক্ষে নতুন ভর্তি নেওয়া হয়। তাহলে যতজন নিয়মিত ছাত্র আছে তত সিটই আছে। তবু কেন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা হলে সিট পান না? কারণ ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও দুই-তিনটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা হলে অবস্থান করেন। সেই সঙ্গে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সিট দখলদারিত্ব তো আছেই! এখন যখন নতুন হল হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের আসন সংখ্যা বেড়েছে। ফলে শিক্ষার্থী ভর্তি সংখ্যাও বাড়বে। নতুন আঙ্গিকে দখলদারিত্ব শুরু হবে। ফলে সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ না করে, নতুন হল দিয়ে আবাসন সমস্যার সংকটের আশা ‘কুমিরের বাচ্চা দেখানোর গল্প’ ছাড়া কিছুই না।
গণরুমের অমানুষিক নির্যাতন : গণরুমের অবাসযোগ্য পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আরেক নারকীয় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পৃথিবীর কোনো সভ্য সমাজে এটা ভাবা যায় না যে, চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবীদের বাছাই করে তাদের গণরুমে রেখে রাত জাগিয়ে ‘ম্যানার শেখানোর’ নামে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়। গণরুমে যা হয় সবকিছু সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অবগত। কিন্তু হল প্রভোস্ট ‘অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা’ শীর্ষক ‘তোতাপাখির বুলি’ ছাড়া কোনো কিছুর ক্ষমতা রাখেন না। প্রক্টর অফিস জানে না, কতটি অভিযোগ তাদের দপ্তরে জমা আছে। র্যাগিং, নবীন শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, রাত জাগিয়ে রাখা, গ্রিলে ঝুলিয়ে রাখা এসব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুমের নিত্যদিনের চিত্র। গণরুমের কাছে গিয়ে কান পাতলেই শোনা যায় কী অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়। একজন সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছাতে বাবা-মায়ের বছরের বছর কী পরিমাণ আত্মত্যাগ করতে হয় তা শুধু মা-বাবাই জানেন। আর সে কাক্সিক্ষত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর রাত জাগিয়ে বাবা-মা’কে গালি শুনানো হয়। এটা কোন সভ্য দেশের প্রক্রিয়া? বাবা-মা কি সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠিয়েছে রাত জেগে তাদের গালি শুনাতে? এসব বছরের পর বছর হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নাকের ডগায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কী করেছে এবং করতে পেরেছে? কিছুই না।
গাছ কাটা নিষেধ : বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ‘অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে মেগা উন্নয়ন প্রজেক্ট চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অংশীজন অতিথি পাখি যাতায়াত, আবাস্থল ও ন্যূনতম গাছ কেটে বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি কোনো পরামর্শ, প্রস্তাবকে আমলে নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার একটা দাবিতে তিনি শেষ পর্যন্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থী দ্বন্দ্বে পরিণত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌহার্দ্যকে বিসর্জন দিয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগরের অংশীজন প্রাণ-প্রকৃতির বেশ যতœশীল ও আবেগপ্রবণ। প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনশনেও বসতে পারেন। এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়, একটি তীব্র আন্দোলনের রেশ না কাটতেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ফের ‘মহাপরিকল্পনা’র বাইরে গিয়ে একটি সংরক্ষিত অঞ্চলে ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ও উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকদের আপত্তির মুখে প্রশাসন এই প্রকল্প অনুমোদন করেছে। এখন ভবন নির্মাণে অমূল্য আরও ৫০০ গাছ কাটা যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে দৈনিক দেশ রূপান্তর, ২৫ মে, ২০২৩।
ইতিমধ্যে অপরিকল্পিত মহাপরিকল্পনার জন্য জাহাঙ্গীরনগরে সবুজ, প্রাণ-প্রকৃতি হুমকির মুখে। অথচ দেশের একমাত্র ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারটি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত। সাবেক ভিসি ফারজানা ইসলাম জানিয়েছিলেন, তাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ‘জাহাঙ্গীরনগরের সুবজ যেন নষ্ট করা না হয়’। অথচ নির্বিচারে গাছের পর গাছ কেটে অপরিকল্পিত উন্নয়নের মধ্যে আবারও ৫০০ গাছ কাটার কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের রেশ বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে পড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। হয়তো আমাদের আগামী ভবিষ্যতের মধ্যে সবচেয়ে কম গরমের বছরটি আমরা পার করছি। আসছে বছর আরও তীব্র তাপপ্রবাহ অপেক্ষা করছে। পরের বছর তীব্রতর। এখন বৃক্ষ সৃজন, প্লাস্টিক বর্জন, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জ্বালানি-নির্ভর বিদুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ করে ধরণীকে বাঁচানোর সময়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটের পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের আসার আগে অন্তত দেশের বুদ্ধিভিত্তিক জায়গাগুলোতে তৈরি হওয়া দরকার। ঢাকার মতো জায়গায় যেখানে একটি গাছ মানে একটি অমূল্য হীরা সেখানে সিটি করপোরেশন গাছ কেটে ফেলছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ইতিমধ্যে প্রাণ-প্রকৃতি হুমকির সম্মুখীন সেখানে বেপরোয়া প্রশাসন ফের গাছ কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন না পারছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা করতে, না পারছে মেধাবী তরুণদের জীবনকে গতিশীল রাখতে।
অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড সাধারণত বিভিন্ন গুদামজাত শস্যকে পোকামাকড় থেকে রক্ষা করার জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে ইঁদুর দমনে এই ওষুধের জুড়ি নেই। কিন্তু ছারপোকা, আরশোলা দমনের নামে এই পেস্ট বিভিন্ন ধরনের ট্যাবলেট আকারে যথেচ্ছ ব্যবহৃত হচ্ছে। মারাত্মক কীটনাশক অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড বাতাসের সংস্পর্শে গেলেই রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। প্রকাশ করে তার আসল ক্ষমতা। এই মারাত্মক কীটনাশক, বাতাসে মিশে গিয়ে উৎপাদন করে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফাইন। এই গ্যাসের কারণেই মৃত্যু হয় পোকামাকড়ের। কিন্তু বাসাবাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ থাকলে, গ্যাস বাতাসের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় ঘরের মধ্যে। কোনো মানুষ যখন শ^াসপ্রশ^াসের মাধ্যমে সেই গ্যাস টেনে নেন, তখনই তিনি ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে। সামান্য সময়ের ব্যবধানে, প্রাথমিক উপসর্গ হিসেবে শুরু হয় মাথাধরা, বমি। একপর্যায়ে মানুষ অচেতন হয়ে পড়ে। বেশি পরিমাণে তা শরীরের মধ্যে প্রবেশ করলে মৃত্যু সুনিশ্চিত। যে কারণে ছারপোকা, আরশোলা, ইঁদুর বা কোনো ধরনের পোকামাকড় বিনাশ করতে চাইলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী, যে কোনো পেস্ট কন্ট্রোল বা ট্যাবলেট ব্যবহার করা উচিত। কম সময় ও সঠিক উপায়ে এইসব পোকামাকড় দূর করার পদ্ধতিই হচ্ছে-পেস্ট কন্ট্রোল। শহর বা গ্রামে এ সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকার কারণে, প্রায়ই মৃত্যু বা গুরুতর অসুস্থতার খবর জানা যাচ্ছে।
খোদ রাজধানীর বিভিন্ন পাবলিক বাস, ফুটপাত অথবা বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যেই এই ট্যাবলেট বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ‘পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস’র নামে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, সেই প্রতিষ্ঠানে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কর্মীরা জানেনই না, তারা কী ধরনের ওষুধ বাসাবাড়িতে স্প্রে করছেন! অধিকাংশই অনুমোদনহীন এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রশাসনিক তৎপরতার খবর কেউ জানে না। গতকাল দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত ‘বাসায় পেস্ট কন্ট্রোলে মৃত্যুঝুঁকি’ সংবাদের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে, বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সংবাদে আরও বলা হয়েছে, পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
আসলে পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরণের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে, সেই তথ্য কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে আছে, আমাদের জানা নেই। এও জানা নেই, সেই ওষুধে কোন কেমিক্যালের মিশ্রণ ঘটানো হচ্ছে? রাস্তাঘাটে যখন সাধারণ মানুষের কানে আসে চিৎ হইয়া মরবো, কাইৎ হইয়া মরবো, ধরফরাইয়া মরবো, উপ্তা হইয়া মরবো, পাও চ্যাগাইয়া মরবো তখনই শহরের বিভিন্ন এলাকার ভ্যানগাড়ি বা পাবলিক বাসে হকারদের কথার ছন্দে আকৃষ্ট হয়ে তারা নিয়মিতভাবে ক্রয় করছেন এই ওষুধ। এসব কেমিক্যাল স্প্রে বা ট্যাবলেট বিক্রির বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। একইসঙ্গে জনগণকে সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়াও জরুরি।
প্রখ্যাত ব্রিটিশ অণুজীববিজ্ঞানী, জৈব পদার্থবিদ এবং স্নায়ুবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস হ্যারি কম্পটন ক্রিক ১৯১৬ সালের ৮ জুন জন্মগ্রহণ করেন। ওয়াটসন ও মরিস উইলকিন্সের সঙ্গে যৌথভাবে ডিএনএ মলিকিউলের কাঠামো আবিষ্কার করেন তিনি। তাদের এই আবিষ্কারে নিউক্লেয়িক অ্যাসিডের আণবিক কাঠামো, ডাবল হেলিক্স এবং জীবিত সত্তার দেহে তথ্য স্থানান্তরে এর ভূমিকার কারণে ১৯৬২ সালে যৌথভাবে ফিজিওলজি বা মেডিসিনে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন ফ্রান্সিস ক্রিক। বিশ্বসেরা একজন অণুজীববিজ্ঞানী হিসেবে তার গবেষণাগুলো জেনেটিক কোডের রহস্য উন্মোচনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নোবেল প্রাপ্তির পরের সময়টা থেকে বাকি জীবন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ‘সাল্ক ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজিক্যাল স্টাডিজ’-এ গবেষণা করে কাটিয়েছেন ফ্রান্সিস ক্রিক। পরবর্তী জীবনে তার গবেষণার কেন্দ্রে চলে আসে তাত্ত্বিক স্নায়ুবিজ্ঞান এবং মানুষের স্নায়বিক চৈতন্যবিষয়ক বৈজ্ঞানিক গবেষণা। ফ্রান্সিস ক্রিকের জন্ম হয়েছিল যুক্তরাজ্যের নর্থহ্যাম্পটনে। তার বাবার নাম হ্যারি ক্রিক ও মায়ের নাম অ্যানি এলিজাবেথ ক্রিক। তার বাবা ও চাচা বুট ও জুতো তৈরির পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। নর্থহ্যাম্পটন গ্রামার স্কুলে পড়ালেখার পর ১৪ বছর বয়সে ফ্রান্সিস বৃত্তি নিয়ে লন্ডনে পড়তে চলে যান। সেখানে গণিত, পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। ১৯৩৭ সালে লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ফ্রান্সিস একজন বিদেশি হিসেবে ‘আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব আর্টস’-এর সম্মানসূচক সদস্যপদ লাভ করেন এবং ১৯৯১ সালে ‘ব্রিটিশ অর্ডার অব মেরিট’-এ ভূষিত হন।
গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত অভিযোগে দেশের কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টা বক্তব্য দিতেও শুরু করেছে। এতে বিরোধীপক্ষেরই ঝুঁকি দেখছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই সবপক্ষই চাপে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থান নিয়ে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা হলেও মূলত নির্বাচনী রাজনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তন আসবে। একপক্ষ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও সেই পথ থেকে তাদেরও সরতে হবে। আবার সরকারপক্ষ যেনতেন নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসে যাবে সেই সুযোগও থাকছে না। যে যাই বলুক নির্বাচনী রাজনীতিতে সামনের দিনগুলোতে এ পরিবর্তন আসতেই হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবপক্ষের জন্য। তাদের অবস্থানে বিএনপি উৎফুল্ল হয়ে যাবে, আর আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন নয়। বরং এতে এক ধরনের সমাধানের পথ খুলে যেতে পারে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ না দিলেও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে এমন আভাস দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু গত বছর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আসছে। তাদের একাধিক প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করে সরকার ও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে সমর্থনের কথা জানিয়ে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রয়োগের কথা জানানো হলো গত শুক্রবার।
এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা ও র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভিসানীতি প্রয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অনড় অবস্থানের বিষয়টি আবার জানাল। দেশটির এ অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দেখছে দুভাবে। একটি হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। দ্বিতীয়টি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করা বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। এর বাইরে অন্য কোনো বিরূপ প্রভাব দেখছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকার এত দিন যেটা চেয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র সেটাই আশা করছে।
তবে বিএনপি ভিসানীতির জন্য সরকারকে দায়ী করেছে এবং সেটা তাদের নেতাকর্মীদের এক দফা আন্দোলনে আরও উজ্জীবিত করবে, এমন দাবি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কারণে আগামী নির্বাচন যেনতেনভাবে হয়ে যাবে সেটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রস্তুতি সবাইকে নিতে হবে। এর বাইরে কোনো রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তা যেই হোক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করা বা একপেশে করার চিন্তা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে চাইলে, পড়তে হবে ভিসানীতির আওতায়। যুক্তরাষ্ট্রের অনড় অবস্থান এখন পর্যন্ত সেটাই ইঙ্গিত করে।’
সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে এক দফা দিয়ে আন্দোলনে আছে বিএনপি। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য এক দফা ঘোষণা করেছে। তারাও শান্তি-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। সেটা নিশ্চিত করতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ এটাও বলে আসছে, তাদের সরকারের চাওয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া একই।
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দুভাবে দেখলেও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে নানা রকম কানাঘুষা রয়েছে। ভেতরে-ভেতরে ‘ভেঙে পড়লেও’ ওপরে শক্ত মনোভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নতুন কিছু নয়। দুপক্ষের অবস্থান একই বলেও দাবি করেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যে অবস্থান তাতে বিএনপিরই ক্ষতি, কারণ তারা ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন হতে দেবে না।’ তিনি বলেন, সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় সরকার। সেখানে সব দল নির্বাচনে আসুক সেই আহ্বানও জানানো হয়েছে।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত এবং সহযোগিতা করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই ব্যক্তিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা জোরালোভাবে দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র তো বিএনপির দাবি সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান সেখানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে এসব বলা হয়নি। ফলে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করায় আওয়ামী লীগ বা সরকার কেন বেকায়দায় পড়বে? আমরা মনে করি, বিএনপিই তো বেকায়দায় রয়েছে। কারণ, তাদের দাবি অসাংবিধানিক। আর অসাংবিধানিক উপায় অবলম্বন করছে। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের এই অনড় অবস্থান বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের দাবি, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত বিএনপি। তারা তো বিএনপির একটা দাবির কথাও বলে নাই।’ সরকার বা আওয়ামী লীগ ভীত ও শঙ্কিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের উচিত বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানা।’
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেমন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই, আমেরিকারও একই রকম চাওয়া।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র যে এমন কিছু করবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। এটা সিম্পল ব্যাপার আমাদের জন্য।’
ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় বিরোধী দল আছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যে বক্তব্য এসেছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিবৃতিতে কোন বিরোধী দলের কথা বলা হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে আজকে দেশে গণতন্ত্রের যে সংকট তার জন্য সরকার এককভাবে দায়ী। তা ছাড়া এর আগে বাইডেন প্রশাসন তাদের দেশে যে গণতন্ত্রের সম্মেলন করেছে তাতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি।’
ভিসানীতি প্রয়োগের জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আজকে আওয়ামী লীগ বিগত দুটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন করার পর আবারও আগামী নির্বাচন একতরফা করতে যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। এর দায় সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। আজকে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ আগের ঘোষণার ধারাবাহিকতা। প্রথমদিকে নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে, সাধারণ মানুষের ভেতর যে বড় ধাক্কা মনে হয়েছিল, ঘোষণা আসার পর সেটা মনে হয়নি। তবে কোনো একটা সমীকরণ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এর প্রভাব কত দূর যাবে সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনে কী বার্তা যাবে সেটা পরিষ্কার নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা তাদের বৈশি^ক চর্চারই অংশ। মূল কথা হলো, এটা সবার জন্যই চাপ।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে পুলিশ। নির্বাচনে কী উপায়ে নিরাপত্তা দেওয়া হবে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। তবে সরকারের হাইকমান্ড থেকে পুলিশ সদর দপ্তরে তথ্য এসেছে, ঘাপটি মেরে থাকা পুলিশের কিছু কর্মকর্তা ও সদস্য সরকারবিরোধীদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখছে। পুলিশের একটি প্রতিবেদনেও তথ্য এসেছে সারা দেশে অন্তত আড়াইশো কর্মকর্তা আছেন তারা সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত। তাদের পুরো কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
এদিকে, চলতি মাস ও আগামী মাসের মধ্যে পুলিশে আরও বড় ধরনের রদবদল করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে তালিকাও করা হয়েছে। পাশাপাশি উন্নতমানের আগ্নেয়াস্ত্রসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদিও কেনার চেষ্টা করছে পুলিশ সদর দপ্তর।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানান, সামনের দিনগুলোতে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা। এ নিয়ে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা আগাম সতর্কবার্তাও দিয়েছে। যেকোনো বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ করতে কিছুদিন আগে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পুলিশের সবকটি ইউনিট প্রধান ও জেলার এসপিদের কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছে। বার্তায় বলা হয়েছে রাজনৈতিক দুবৃর্ত্তায়নের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি পুলিশের মধ্যে কোনো সদস্য সরকারবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার তথ্য পেলে জানাতে বলা হয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশেই সব পুলিশ সদস্যকে সতর্ক থাকতে হবে। নির্বাচনকালীন যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। পেশাদার সন্ত্রাসীসহ অন্য অপরাধীদের ধরতে বিশেষ অভিযান চালাতে হবে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঘাপটি মেরে থাকা পুলিশের কিছু সদস্যের কর্মকান্ড নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। এই সংখ্যা প্রায় আড়াইশো মতো হবে। সংখ্যা আরও বাড়তেও পারে। ইতিমধ্যে তালিকা করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে সরকারের হাইকমান্ডকে অবহিতও করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। যেকোনো পরিস্থিতির জন্য পুলিশকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় পুলিশে উদ্বেগ আছে। বৈধ অস্ত্রের সংখ্যার খোঁজ নেওয়া, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্র কারবারিদের গ্রেপ্তার করতে বিশেষ অভিযান চালাতে ইতিমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে অভিযানের নির্দিষ্ট তারিখ এখনো ঠিক হয়নি। হুট করেই আমরা বিশেষ অভিযান শুরু করব। কেপিআই স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন যথাসময়ে হবে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। নির্বাচন নিয়ে যাতে কোনো মহল বা চক্র নাশকতামূলক কর্মকান্ড চালাতে না পারে সে জন্য মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সতর্ক আছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশন) আনোয়ার হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে পুলিশের সবধরনের প্রস্তুতি আছে। দাগি সন্ত্রাসীসহ অন্য অপরাধীদের ধরা ও আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করতে দ্রুত সময়ের মধ্যে বড় ধরনের অভিযান চালানোর পরিকল্পনা আছে আমাদের।
পুলিশ সূত্র জানায়, আড়াইশো পুলিশ কর্মকর্তার কর্মকান্ড নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। তাদের মোবাইল নম্বর সার্বক্ষণিক ট্র্যাকিং করা হচ্ছে। এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদেরও খোঁজ রাখা হচ্ছে। নজরদারির মধ্যে থাকা বেশ কয়েকজন পুলিশ সুপার, অ্যাডিশনাল পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, ইন্সপেক্টর, সাব-ইন্সপেক্টর আছেন। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের অ্যাডিশনাল ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতাদের সাপোর্ট দেওয়া আমাদের কাজ না। জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আমাদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের জন্য উন্নতমানের আগ্নেয়াস্ত্র ও যানবাহন ক্রয় করা হচ্ছে। পাশাপাশি ৫০ লাখের মতো রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড কেনা হচ্ছে। আগামী মাসের মধ্যে এসব সরঞ্জাম বাংলাদেশে আসবে বলে আশা করছি। ডিএমপি, সিএমপি, কেএমপি, আরএমপি, বিএমপি, এসএমপি, আরপিএমপি, জিএমপি কমিশনার, বিশেষ শাখা (এসবি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), অপরাধ তদন্ত বিভাগ, পিবিআই, টুরিস্ট পুলিশ, এটিইউ, রেলওয়ে পুলিশ, নৌপুলিশ, এপিবিএন, হাইওয়ে, শিল্পাঞ্চল পুলিশ প্রধান, সব অ্যাডিশনাল আইজিপি, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা ও রংপুর রেঞ্জে নতুন আগ্নেয়াস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি পাঠানো হবে। ইতিমধ্যে ইউনিট প্রধানরা পুলিশ সদর দপ্তরে চাহিদাপত্র পাঠিয়েছেন। বিষয়টি আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারবিরোধীরা নানা ষড়যন্ত্র করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে উঠেপড়ে লেগেছে তারা। বিএনপি আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও করছে। তারা পুলিশের ওপর হামলা করছে। যানবাহনে আগুন দিচ্ছে। আর এসব মোকাবিলা করতে পুলিশকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে। অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে পুলিশ সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। অপরাধীদের ধরতে পুলিশের বিশেষ অভিযান শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
কে নিষেধাজ্ঞা দেবে বা দেবে না, তা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, যারা নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছেন, তাদের দেশের নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আগামী নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে বিদেশ থেকে যদি কোনো প্রচেষ্টা নেওয়া হয়, দেশের জনগণ তা মেনে নেবে না।
নিউ ইয়র্কে স্থানীয় সময় শুক্রবার বেলা ২টায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তার ভাষণের পরপরই এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলন শুরুর কিছুক্ষণ আগেই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি বাংলাদেশের ওপর প্রয়োগ শুরু হয়েছে বলে এক বিবৃতিতে জানায় দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিরোধী দলসহ নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টাকারীদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে বলে তিনি আশা করেন। তিনি বলেন, আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এটা ভালো হবে। কারণ বিএনপি জোট ২০১৩-১৪ সালের মতো নির্বাচন বানচালের লক্ষ্যে কোনো অগ্নিসংযোগ করতে পারবে না। যে দেশ ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তারা উভয় পক্ষ থেকে বা নিরপেক্ষভাবে বিষয়টি বিবেচনা করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন সরকারপ্রধান।
শেখ হাসিনা বলেন, দেশবাসী ভোট দিলে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে। তার দল সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাস করে। নির্বাচন বানচালে যারা উদ্যোগ নেবে, বাংলাদেশের জনগণ তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু আওয়ামী লীগকে টার্গেট করলে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ কারও শক্তির ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় আসেনি। আমি জনগণের শক্তি এবং তাদের ভোটে ক্ষমতায় এসেছি।’ জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, খালেদা জিয়া বারবার তাকে হত্যার চেষ্টা করেছেন। তা সত্ত্বেও সরকারপ্রধান হিসেবে তার ওপর অর্পিত ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি খালেদা জিয়াকে কারাদণ্ড স্থগিত করে বাড়িতে থাকার এবং হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, তার সরকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও) আওতা থেকে বের করে এনে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য প্রথম আইন প্রণয়নের পাশাপাশি তাদের সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিয়েছে।
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স এবং ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রবর্তনের প্রস্তাব করেছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া নির্বাচনে কারচুপির জন্য ভোটার তালিকায় ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার যুক্ত করেছিলেন। তার সরকার অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ অসংখ্য নির্বাচন করেছে, যেখানে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে কেউ ক্ষমতায় আসতে চাইলে তাদের সংকটের মুখোমুখি হতে হবে। যারা বিশৃঙ্খলা বা দেশের সংবিধান লঙ্ঘনের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করতে চায় তাদের ব্যাপারে তিনি দেশবাসীকে সতর্ক করেন। তিনি বলেন, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের কোনো সুযোগ নেই।
দুর্নীতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব্যাপক দুর্নীতি থাকলে বাংলাদেশ বিশাল উন্নয়নের রোলমডেল হতে পারত না। সরকার শুধু মেগা প্রকল্পই তৈরি করেনি, উন্নয়নকে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে।
তার সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, কোনো অপপ্রচারে কান দেবেন না। কিছু লোক আছে যারা দেশের কল্যাণ চায় না। প্রবাসীরা সচেতন থাকলে এই স্বার্থান্বেষী মহল সফল হতে পারবে না। এ লক্ষ্যে অপপ্রচারকে অস্বীকার করে যথাযথ উপায়ে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
নিউ ইয়র্কে নাগরিক সংবর্ধনা : নিউ ইয়র্কে স্থানীয় সময় শুক্রবার সন্ধ্যায় এক নাগরিক সংবর্ধনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তার দৃঢ় সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, বিএনপি কি আসলেই নির্বাচন চায়, তাদের নেতা কে?
বিএনপি নির্বাচন চায় না উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে, ইনশা আল্লাহ। জনগণ সঠিকভাবে ভোট দেবে।
তিনি আরও বলেন, পলাতক আসামি, অর্থ চোর, অস্ত্র চোরাচালানকারী, খুনি ও ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকারী (তাদের নেতা) এই যদি একটি দলের নেতা হয়, তবে মানুষ কেন সেই দলকে এবং তাকে ভোট দেবে?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোট পায়নি এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচন ঠেকানোর নামে অগ্নিসংযোগ করে মানুষ হত্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কত প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এখনো সেই পোড়া মানুষের মুখ দেখলেই বোঝা যাবে যে কী জঘন্য কাজ হয়েছে। যারা এটি করেছে, তাদের মতো আর কেউ ঘৃণ্য হতে পারে না।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের অন্তত অনুধাবন করা উচিত যে তারা নৌকায় (আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক) ভোট দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে এবং নৌকার পক্ষে ভোট দেওয়ায় আজ জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। নৌকায় (দেশের জনগণ) ভোট দেওয়ার কারণে সারা বিশে^ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।’
সরকারপ্রধান বলেন, যারা বিদেশে থাকেন, তাদের বুঝতে হবে বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে বিদেশে কারও সঙ্গে কথা বলা যেত না, এখন মানুষ বাংলাদেশকে সম্মানের চোখে দেখে।
অপপ্রচারে কর্ণপাত না করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যেন সব সময় উজ্জ্বল হয়, তা আপনাদের সবাইকে সর্বদা মনে রাখতে হবে।’
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আজ যখন বিশ্বনেতারা (বাংলাদেশের সাফল্য) স্বীকৃতি দিচ্ছেন, তখন আমাদের কিছু পাপাচারী যা বলছে, তাতে মনোযোগ দেওয়ার দরকার নেই। বিভিন্ন অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্তরা এখন বিশে^র বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং তাদের অপকর্ম ধামাচাপা দিতে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ও অ্যাপসের মাধ্যমে বিভিন্ন মিথ্যা অপবাদ ছড়াচ্ছে।’
নিন্দুকদের মুখোশ উন্মোচন করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিথ্যা অপপ্রচার করলে তাদের মুখ উন্মোচিত করতে হবে। মানুষের সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করা দরকার।
যুক্তরাষ্ট্র গত মে মাসে ভিসানীতি আরোপের ঘোষণা দিয়েছিল। শুক্রবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যায় তারা ভিসানীতি ঘোষণার কার্যকারিতার কথা জানালো। এই ভিসানীতি কার্যকারিতার কথা তারা তখন জানালো যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৭৮তম অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় গত শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়ার এক বৈঠকে আবারও বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়।
ওই বৈঠকের পর আজরা জেয়া নিজেই এক্সে (সাবেক টুইটার) সচিত্র একটি পোস্ট দিয়েছেন। এতে তিনি লিখেছেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশ, কানাডা, গাম্বিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের একটি সাইড ইভেন্টের আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আবারও যুক্ত হতে পেরে সম্মানিতবোধ করছি। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, অংশীদারত্বের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি এবং ৯ লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে উদারতার সঙ্গে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেছি।’
বৈঠকে আজরা জেয়া প্রধানমন্ত্রীকে জানান, তারা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জন্য ১১৬ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জেয়া রোহিঙ্গাদের উন্নত জীবিকা নিশ্চিত করতে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেন।
জবাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা উচিত, অন্যথায় এই অঞ্চল নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে। কারণ রোহিঙ্গারা ইতিমধ্যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। যার মধ্যে রয়েছে হত্যা, আগ্নেয়াস্ত্র চোরাচালান এবং মাদক কারবার। রোহিঙ্গারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে কারণ তাদের প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে এবং তারা সেখানে কোনো ভবিষ্যৎ অনুভব করছে না।
একটা বিষয় খেয়াল করলে বুঝা যাবে, উজারা জেয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর পরই বাংলাদেশের উপর যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসানীতি কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছে। এতে বুঝা যাচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করেছে। তাদের দাবি ছিলো, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেছেন, তাদেরকে নিজ দেশ ফিরিয়ে নিতে যত তাড়াতাড়ি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত।এ থেকে বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই যে, রোহিঙ্গাদের কর্মসংসস্থানের প্রস্তাব সরাসরি ফিরিয়ে দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র নাখোশ হয়েছে। এই প্রস্তাব ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আর কী কী প্রস্তাব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছিল তা আমরা জানি না। মনে হচ্ছে, এমন কিছু প্রস্তাব হয়তো প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছিল যেগুলো তিনি নাকচ করে দিয়েছেন।এবার আসা যাক বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। অনেকদিন ধরে তারা সেটি বলে আসছে। বাংলাদেশের তরফ থেকেও বার বার জানানো হয়েছে যে, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হবে। তারপরও তারা ভিসানীতি আরোপ করে সেটি কার্যকর করতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- নির্বাচন তো এখনও হয়নি। তার আগেই কেন ভিসানীতি আরোপ ও কার্যকর করা হলো?
এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতেই এসব ভিসানীতি, নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। গণতন্ত্র, অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক ভোট শুধুমাত্র ইস্যু। নিজের দেশেই আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করতে নানান কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। নিজের দেশেই যেখানে বাইডেন প্রশাসন প্রশ্নবিদ্ধ সেখানে অন্যদেশের গণতন্ত্র নিয়ে তাদের এতো মাথা ব্যাথা কেন?
বাংলাদেশেই যে তারা প্রথম ভিসানীতি আরোপ বা নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা কিন্তু নয়। সাম্প্রতিক অতীত ঘাটলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্র আরও বহু দেশের সরকারের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদদের উপর একইভাবে ভিসানীতি এবং নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এটা নতুন কিছু নয়। যেখানেই তাদের স্বার্থ জড়িত সেখানেই তারা একই পথে হেঁটেছে। কিন্তু কোথাও তারা সফল হতে পারেনি। সব জায়গা থেকেই ফিরেছে শূন্য হাতে। আমরা যদি ভেনিজুয়েলা থেকে শুরু করে সিরিয়া, ইরান, মিশর, তুরস্ক, রাশিয়া, বেলারুশের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো এদের সবার উপরই নিষেধাজ্ঞা জারি কিংবা ভিসানীতি আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু খুব একটা ফল হয়নি।তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই সেদেশে সামরিক অভ্যূত্থান হয়েছিল। সেই অভ্যূত্থানে যুক্তরাষ্ট্র ইন্ধন দিয়েছিল। ২০২১ সালে তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেইমান সৌলু যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনের বিষয়টি স্পষ্ট করেন। ভেনিজুয়েলায় নিজেদের পছন্দের লোক গুইদুকে প্রেসিডেন্ট করতে না পেরে মাদুরোকে বার বার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।পাঠকদেরকে হালের একটা তথ্য দিয়ে রাখি। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ভারতের মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রের উপরও। ১৯৯২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। বারাক ওবামা ভারত সফরের পর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তার সফরের বেশ কিছু দিন পর ভারত নাসার সঙ্গে চুক্তি করল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। গুজরাট দাঙ্গার কারণে তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। পরবর্তিতে নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাবে, কারা সরকার পরিচালনা করবে- সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক শুধুই বাংলাদেশের জনগণ। এখানে বাইরের রাষ্ট্র সে যুক্তরাষ্ট্র হোক কিংবা অন্য কোনো দেশ হোক কারোরই হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাবে, কারা সরকার পরিচালনা করবে- সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক শুধুই বাংলাদেশের জনগণ। এখানে বাইরের রাষ্ট্র সে যুক্তরাষ্ট্র হোক কিংবা অন্য কোনো দেশ হোক কারোরই হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। যখনই বাইরের কোনো রাষ্ট্র কোনো অজুহাতে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করবে তখনই বুঝতে হবে ওই দেশের বৃহত্তর স্বার্থ আছে। আর এসব নিষেধাজ্ঞা, ভিসানীতি আরোপে এদেশের সাধারণ মানুষের কিছুই যায় আসে না। কারণ বাংলাদেশের মানুষ নিজেরাই নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্ত করেছে এবং করছে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী নিজামুল হক বিপুল
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে পুলিশ। নির্বাচনে কী উপায়ে নিরাপত্তা দেওয়া হবে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। তবে সরকারের হাইকমান্ড থেকে পুলিশ সদর দপ্তরে তথ্য এসেছে, ঘাপটি মেরে থাকা পুলিশের কিছু কর্মকর্তা ও সদস্য সরকারবিরোধীদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখছে। পুলিশের একটি প্রতিবেদনেও তথ্য এসেছে সারা দেশে অন্তত আড়াইশো কর্মকর্তা আছেন তারা সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত। তাদের পুরো কর্মকান্ড খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
এদিকে, চলতি মাস ও আগামী মাসের মধ্যে পুলিশে আরও বড় ধরনের রদবদল করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে তালিকাও করা হয়েছে। পাশাপাশি উন্নতমানের আগ্নেয়াস্ত্রসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদিও কেনার চেষ্টা করছে পুলিশ সদর দপ্তর।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানান, সামনের দিনগুলোতে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা। এ নিয়ে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা আগাম সতর্কবার্তাও দিয়েছে। যেকোনো বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ করতে কিছুদিন আগে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পুলিশের সবকটি ইউনিট প্রধান ও জেলার এসপিদের কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছে। বার্তায় বলা হয়েছে রাজনৈতিক দুবৃর্ত্তায়নের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি পুলিশের মধ্যে কোনো সদস্য সরকারবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার তথ্য পেলে জানাতে বলা হয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশেই সব পুলিশ সদস্যকে সতর্ক থাকতে হবে। নির্বাচনকালীন যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। পেশাদার সন্ত্রাসীসহ অন্য অপরাধীদের ধরতে বিশেষ অভিযান চালাতে হবে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঘাপটি মেরে থাকা পুলিশের কিছু সদস্যের কর্মকান্ড নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। এই সংখ্যা প্রায় আড়াইশো মতো হবে। সংখ্যা আরও বাড়তেও পারে। ইতিমধ্যে তালিকা করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে সরকারের হাইকমান্ডকে অবহিতও করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। যেকোনো পরিস্থিতির জন্য পুলিশকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় পুলিশে উদ্বেগ আছে। বৈধ অস্ত্রের সংখ্যার খোঁজ নেওয়া, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্র কারবারিদের গ্রেপ্তার করতে বিশেষ অভিযান চালাতে ইতিমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে অভিযানের নির্দিষ্ট তারিখ এখনো ঠিক হয়নি। হুট করেই আমরা বিশেষ অভিযান শুরু করব। কেপিআই স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন যথাসময়ে হবে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। নির্বাচন নিয়ে যাতে কোনো মহল বা চক্র নাশকতামূলক কর্মকান্ড চালাতে না পারে সে জন্য মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সতর্ক আছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশন) আনোয়ার হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে পুলিশের সবধরনের প্রস্তুতি আছে। দাগি সন্ত্রাসীসহ অন্য অপরাধীদের ধরা ও আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করতে দ্রুত সময়ের মধ্যে বড় ধরনের অভিযান চালানোর পরিকল্পনা আছে আমাদের।
পুলিশ সূত্র জানায়, আড়াইশো পুলিশ কর্মকর্তার কর্মকান্ড নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। তাদের মোবাইল নম্বর সার্বক্ষণিক ট্র্যাকিং করা হচ্ছে। এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদেরও খোঁজ রাখা হচ্ছে। নজরদারির মধ্যে থাকা বেশ কয়েকজন পুলিশ সুপার, অ্যাডিশনাল পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, ইন্সপেক্টর, সাব-ইন্সপেক্টর আছেন। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের অ্যাডিশনাল ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতাদের সাপোর্ট দেওয়া আমাদের কাজ না। জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আমাদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের জন্য উন্নতমানের আগ্নেয়াস্ত্র ও যানবাহন ক্রয় করা হচ্ছে। পাশাপাশি ৫০ লাখের মতো রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড কেনা হচ্ছে। আগামী মাসের মধ্যে এসব সরঞ্জাম বাংলাদেশে আসবে বলে আশা করছি। ডিএমপি, সিএমপি, কেএমপি, আরএমপি, বিএমপি, এসএমপি, আরপিএমপি, জিএমপি কমিশনার, বিশেষ শাখা (এসবি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), অপরাধ তদন্ত বিভাগ, পিবিআই, টুরিস্ট পুলিশ, এটিইউ, রেলওয়ে পুলিশ, নৌপুলিশ, এপিবিএন, হাইওয়ে, শিল্পাঞ্চল পুলিশ প্রধান, সব অ্যাডিশনাল আইজিপি, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা ও রংপুর রেঞ্জে নতুন আগ্নেয়াস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি পাঠানো হবে। ইতিমধ্যে ইউনিট প্রধানরা পুলিশ সদর দপ্তরে চাহিদাপত্র পাঠিয়েছেন। বিষয়টি আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারবিরোধীরা নানা ষড়যন্ত্র করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে উঠেপড়ে লেগেছে তারা। বিএনপি আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও করছে। তারা পুলিশের ওপর হামলা করছে। যানবাহনে আগুন দিচ্ছে। আর এসব মোকাবিলা করতে পুলিশকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে। অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে পুলিশ সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। অপরাধীদের ধরতে পুলিশের বিশেষ অভিযান শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
উত্তরাধিকার সূত্রে বা পারিবারিক পরিচয়ে রাজনীতির চর্চা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এ উপমহাদেশে। বাবার সূত্রে কিংবা দাদার সূত্রে রাজনীতিতে এসে অনেকে পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে গেছেন। আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। রাজনীতিতে হয়েছেন বটবৃক্ষ। আবার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও উত্তরাধিকার সূত্রে পদ-পদবি পেয়ে যাওয়ার উদাহরণও আছে। যারা এভাবে রাজনীতিতে এসেছেন, তারা কার্যত বনসাই হয়ে আছেন।
দেশের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ প্রায় সব দলেই উত্তরাধিকারের চর্চা রয়েছে। পারিবারিক সূত্রে এমপি হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান একাদশ সংসদে এ সংখ্যা ৯৮। স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ জাগায় যে, আগামী দ্বাদশ সংসদে এ সংখ্যা কত হবে? যদিও বর্তমান সংসদের ৩৪টি উপনির্বাচনে উত্তরাধিকার সূত্রে এমপি হয়েছেন কমই।
রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের চর্চা যে খারাপ সেটা মোটেও বলা যাবে না। বরং উত্তরাধিকারের কারণে দেশের জন্য, জনগণের জন্য অবদান রাখা ঐতিহ্যবাহী দল আরও শক্তিশালী হওয়ার উজ্জ্বল উদাহরণও আছে। যেমন ভারতের রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধী। বাবা নেহরু গান্ধীর উত্তরসূরি হলেও নিজের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে কংগ্রেসের রাজনীতিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছেন। তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। টানা তিনবারসহ চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঘটেছে। আরও শক্তিশালী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছে।
বিএনপির ক্ষেত্রেও বলা যায়, দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলটির হাল ধরেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। তাদের ছেলে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
সংসদের ৩০০ আসনে উত্তরসূরি হিসেবে বা পারিবারিক পরিচয়ে মনোনয়ন পাওয়ার পাশাপাশি সংরক্ষিত ৫০ আসনেও এই চর্চা আছে। বরং হিসাব করলে বেশিই দেখা যায়।
সব মিলিয়ে একাদশ সংসদেই উত্তরসূরি বা পারিবারিক পরিচয়ে এমপি রয়েছেন শতাধিক। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৭টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসা সরকারি দলের এমপির সংখ্যা ৮৬। এর মধ্যে প্রায় ৭০ জনই মাঠের রাজনীতি করে আসেননি। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ২৯ জনের মধ্যে এই সংখ্যা ৭। এ ছাড়া সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি।
একাদশ সংসদে বিএনপির সাতটি আসন ছিল। এর মধ্যে একটি সংরক্ষিত নারী আসন। তাদের মধ্যে রুমিন ফারহানা সংরক্ষিত আসনে এমপি হন। তার বাবা অলি আহাদ আওয়ামী লীগের প্রথম প্রচার সম্পাদক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বা সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলের প্রভাব ধরে রাখতে নেতার পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে আনা হয়। আবার অনেক সময় যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে না ওঠায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তবে উত্তরাধিকার চর্চার প্রভাব নিয়ে সতর্ক করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এমন চর্চার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। সংসদে দেখা যায়, অনেকে বক্তব্য দিতে পারেন না। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিও বোঝেন না। আবার জনসমাবেশে অরাজনৈতিক আচরণ করেন, যা সরকার বা দলকে বেকায়দায় ফেলে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি গণতন্ত্র ও আধুনিক রাজনীতির বিরোধী। দলের জন্য ও রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর।’ তিনি বলেন, ‘গত ১৫-২০ বছরে এ ধারার রাজনীতির চর্চা বেশি হচ্ছে বলেই দুর্বল হয়েছে রাজনীতি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষা বা যোগ্যতা থাকলে এটা গ্রহণ করা যায়। উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদে এত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা অবশ্যই দুশ্চিন্তার। আমি মনে করি, এ সংখ্যা নিয়ে প্রত্যেক দলেরই চিন্তার ব্যাপার আছে। কারণ দাদা, বাবার যোগ্যতায় এসব পদ পেয়ে থাকলে গণতন্ত্র কতটা মজবুত করবে, সেটাও ভাবতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রে উত্তরাধিকারের সুযোগ নেই। আবার এটাকে ধর্মগ্রন্থের বাণী মনে করলেও চলবে না। কারও যদি যোগ্যতা থেকে থাকে, তাহলে বাবা-দাদা থাকলে আসতে পারবেন না সেটাও তো হতে পারে না।’
আওয়ামী লীগের যারা : এমপি ও মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন পঞ্চগড় থেকে নির্বাচিত। তার বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম ১৯৭০, ’৭৩, ’৭৯ ও ’৮৬ সালের এমপি। দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুর রউফ চৌধুরী। তিনি ১৯৯৬ সালের এমপি ও দলের নেতা ছিলেন। ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা। এ ছাড়া তিনবার দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
দিনাজপুরের আরেকটি আসন থেকে নির্বাচিত ইকবালুর রহিমের বাবা প্রয়াত আবদুর রহিম। তিনি সত্তরের এমপি ছিলেন। তবে ইকবালুর রহিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দিনাজপুরের আরেকটি আসনের এমপি শিবলী সাদিক। তার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান ফিজুও এমপি ছিলেন।
রংপুর-২ আসনের আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরীর চাচা আনিসুল হক চৌধুরী এমপি ছিলেন। গাইবান্ধা-২ আসনের মাহাবুব আরা গিনি পারিবারিক বিবেচনায় এমপি হয়েছেন। বগুড়া-১ আসনের সাহাদারা মান্নান প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নানের স্ত্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল ১৯৭৩ সালের এমপি প্রয়াত মইন উদ্দীন আহমদের ছেলে। নওগাঁ-৫ আসনের নিজাম উদ্দিন জলিলের (জন) বাবা প্রয়াত আবদুল জলিল ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী। সিরাজগঞ্জ-১ আসনের তানভীর শাকিল জয় প্রয়াত মন্ত্রী ও নেতা মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে। তার দাদা জাতীয় চার নেতার অন্যতম মনসুর আলী। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের ডা. হাবিবে মিল্লাত সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মেয়ের জামাই। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের তানভীর ইমাম প্রয়াত নেতা এইচ টি ইমামের ছেলে। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের মেরিনা জাহান দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রয়াত মযহারুল ইসলামের মেয়ে। তার ভাই চয়ন ইসলামও এমপি ছিলেন। পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবির প্রয়াত আহমেদ তফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি ১৯৭৩ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। মেহেরপুর-১ আসনের ফরহাদ হোসেনের বাবা প্রয়াত মোহাম্মদ সহিউদ্দিন ছিলেন ১৯৭০, ’৭৩ ও ’৮৬ সালের এমপি। কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি সেলিম আলতাফ জর্জের দাদা গোলাম কিবরিয়া ছিলেন এমপি। ঝিনাইদহ-২ আসনের তাহজীব আলম সিদ্দিকীর বাবা প্রয়াত নুরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন দলের নেতা। ঝিনাইদহ-৩ আসনের এমপি শফিকুল আজম খান। তার বাবা প্রয়াত শামসুল হুদা জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্যের ভাই পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য দলের নেতা। অবশ্য রাজনীতিতে স্বপনেরও অবদান রয়েছে। রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বাবা প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। মাগুরা-১ আসনের এমপি সাইফুজ্জামান শিখর। তার বাবা মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান তিনবারের এমপি ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ হেলালের ছেলে শেখ ফারহান নাসের তন্ময় বাগেরহাট-২ আসনের এমপি। বাগেরহাট-৩ আসনের হাবিবুন নাহার খুলনার মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের স্ত্রী। খুলনা-২ আসনের শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল শেখ নাসেরের ছেলে। খুলনা-৩ আসনের মন্নুজান সুফিয়ানের স্বামী আবু সুফিয়ান এ আসনের এমপি ছিলেন। তিনি নিজেও অবশ্য রাজনীতি করেছেন। ভোলা-২ আসনের আলী আজম মুকুল দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের ভাতিজা। ভোলা-৪ আসনের আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বাবা প্রয়াত এমএম নজরুল ইসলাম ১৯৭৯ ও ’৯১ সালের এমপি। টাঙ্গাইল-৬ আসনের আহসানুল ইসলাম সাবেক এমপি হাজি মকবুল আহমেদের ছেলে। টাঙ্গাইলের আরেক আসনের এমপি খান আহমেদ শুভ দলের জেলা সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুকের ছেলে। ফারুক ১৯৭৩ সালে এমপি ছিলেন। ময়মনসিংহ-১ আসনের জুয়েল আরেং সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের ছেলে। ময়মনসিংহ-২ আসনের শরীফ আহমেদের বাবা শামসুল হক চারবারের এমপি। ময়মনসিংহ-১০ আসনের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের বাবা প্রয়াত এমপি আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ। নেত্রকোনার এমপি সাজ্জাদ হাসানের বাবা প্রয়াত আখলাকুল হোসাইন আহমেদ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সৈয়দা জাকিয়া নূর চার জাতীয় নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে ও দলের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বোন। কিশোরগঞ্জের আরেক এমপি রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে। অন্য এমপি নাজমুল হাসান পাপনের বাবা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুুর রহমান। তার মা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আইভি রহমান। মানিকগঞ্জের নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বাবা প্রয়াত সায়েদুর রহমান এমপি ছিলেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত নসরুল হামিদের বাবা হামিদুর রহমান দলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। মা হাসনা হামিদও রাজনীতি করতেন। গাজীপুরের জাহিদ আহসান রাসেল প্রয়াত নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে। সিমিন হোসেন রিমি প্রয়াত জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। মেহের আফরোজ চুমকির বাবা প্রয়াত ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ ও ’৭৩ সালের এমপি। কাজী কেরামত আলীর বাবা কাজী হেদায়েত হোসেন গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। মুজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) বাবা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মীয়। তার আরেক ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরীও এমপি। ফরিদপুর-৩ আসনের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আত্মীয় পরিচয়ে এমপি হন। ফরিদপুরের আরেকটি আসনের এমপি শাহদাব আকবরের মা প্রয়াত এমপি দলের নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। নাহিম রাজ্জাকের বাবা প্রয়াত নেতা ও এমপি আবদুর রাজ্জাক। জয়া সেনগুপ্তা প্রয়াত এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী। এ কে আবদুল মোমেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাই। গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজের (মিলাদ গাজী) বাবা প্রয়াত এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী। মাহবুব আলীর বাবা আছাদ আলী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। আনিসুল হকের বাবা প্রয়াত সিরাজুল হক ১৯৭০ সালের এমপি ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা। রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বাবা এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সী ছিলেন জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের এমপি। দীপু মনির বাবা প্রয়াত এমএ ওয়াদুদ ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আয়েশা ফেরদাউসের স্বামী প্রয়াত এমপি মোহাম্মদ আলী। মাহফুজুর রহমানের বাবা মুস্তাফিজুর রহমান ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাবা প্রয়াত ফজলুল কবির চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। মহিবুল হাসান চৌধুরীর বাবা চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বাবা প্রয়াত এমপি আখতারুজ্জামান চৌধুরী। সাইমুম সরওয়ার কমলের বাবা প্রয়াত ওসমান সরওয়ার চৌধুরী ছিলেন ১৯৭৩ সালের এমপি। শাহিনা আক্তার চৌধুরীর স্বামী সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। শিরীন আহমেদের স্বামী প্রয়াত বজলুর রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। নাহিদ ইজাহার খানের বাবা খন্দকার নাজমুল হুদা পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর নিহত সেনা কর্মকর্তা। খাদিজাতুল আনোয়ারের বাবা প্রয়াত এমপি রফিকুল আনোয়ার। ওয়াসিকা আয়শা খানের বাবা প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সার দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। কানিজ ফাতেমা আহমেদের স্বামী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী আওয়ামী লীগ নেতা। আঞ্জুম সুলতানা সীমার বাবা কুমিল্লার প্রয়াত নেতা আফজল খান। উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগমের (শিউলী আজাদ) স্বামী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আজাদ। রুমানা আলীর বাবা প্রয়াত এমপি রহমত আলী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের এমপি বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। তার মামা খালেদ মোশাররফ। পারিবারিক পরিচয়ে এমপি হলেও সংগ্রাম এমপি হওয়ার আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সুলতানা নাদিরার স্বামী প্রয়াত নেতা গোলাম সবুর টুলু। হাবিবা রহমান খান শেফালীর বাবা প্রয়াত ফজলুর রহমান খান তিনবারের এমপি ছিলেন। জাকিয়া পারভীন খানমের বাবা সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান খান চুন্নু মিয়া। তার স্বামী আওয়ামী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। অপরাজিতা হকের বাবা প্রয়াত খন্দকার আসাদুজ্জামান ছিলেন তিনবারের এমপি। তামান্না নুসরাত বুবলীর স্বামী প্রয়াত লোকমান হোসেন ছিলেন নরসিংদীর মেয়র। জাকিয়া তাবাসসুমের বাবা প্রয়াত আজিজুর রহমান দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ফরিদা খানম নারী মুক্তিযোদ্ধা। তার স্বামী নোয়াখালী জেলা মুজিব বাহিনী প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত। রাজবাড়ীর সালমা চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী ছিলেন এমপি। সৈয়দা রাশিদা বেগমের স্বামী কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত সৈয়দ নিজাম উদ্দিন লাইট। ফেরদৌসী ইসলাম জেসীর বাবা প্রয়াত ভাষাসৈনিক ও সংসদ সদস্য আ আ ম মেসবাহুল হক বাচ্চু। পারভীন হক সিকদারের বাবা প্রয়াত ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। জামালপুরের আবুল কালাম আজাদ শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভায়রা। এ ছাড়া শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল উদ্দীন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও শামীম ওসমানের পারিবারিক পরিচয় থাকলেও তারা এখন প্রত্যেকে রাজনীতিতে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত।
জাতীয় পার্টি : বিরোধী দলনেতা রওশন এরশাদ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী। তাদের ছেলে সাদ এরশাদও এমপি। আহসান আদেলুর রহমান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ভাগ্নে। জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরও এমপি। নীলফামারী-৪ আসনে আদেলুর রহমান আদেল, তার বাবা ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এমপি ছিলেন। নাসরীন জাহান রত্না দলের কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী। আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান।
অন্যান্য : ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারীর আসনে এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি। মাহী বি চৌধুরীর বাবা সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সেলিনা ইসলামের স্বামী পদচ্যুত এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল।
সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ৫টি রোডমার্চসহ টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করবে দলটি। তবে মাঝে তিন দিন ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর কোনো কর্মসূচি নেই। বিএনপির নতুন ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ, রোডমার্চ ও দোয়া মাহফিল।
গতকাল সোমবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা আন্দোলন শুরু করেছি। আমাদের অনেক রাজনৈতিক জোট ও দল যুগপৎ আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে আমরা কতগুলো কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
কর্মসূচি ঘোষণার সময় অসুস্থতার কারণে মহাসচিবের অনুরোধে সেটি পড়ে শোনান স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
পাঁচটি রোডমার্চ : ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব থেকে সিলেট (সিলেট বিভাগ), ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল থেকে পটুয়াখালী (বরিশাল বিভাগ), ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ (ময়মনসিংহ বিভাগ) এবং ৩ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম (কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম বিভাগ) রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকায় হবে সমাবেশ : ১৯ সেপ্টেম্বর জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী; ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা; ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার, আমিনবাজার; ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ, ৩০ সেপ্টেম্বর শ্রমজীবী সমাবেশ এবং ২ অক্টোবর কৃষক সমাবেশ হবে। এসব কর্মসূচিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
তবে ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির কোনো কর্মসূচি না থাকলেও যুগপৎ আন্দোলনের অংশীজনদের কর্মসূচি রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমাদের যুগপৎ আন্দোলনে যে জোট ও দলগুলো আছে, তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থান থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করবে। তারা হয়তো সবগুলো করবে না।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকাকেন্দ্রিক সমাবেশ-পদযাত্রার কর্মসূচি গণতন্ত্র মঞ্চের : এদিকে গতকাল দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের দারুস সালাম ভবনে ভাসানী অনুসারী পরিষদের কেন্দ্রীয় দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ। নতুন এই কর্মসূচি হচ্ছে ১৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা এবং ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা।
সংবাদ সম্মেলনে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম জোটের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির বাইরে জোটের নিজস্ব কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। তারা বলছে, গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে সেমিনার ও আলোচনা সভাও হবে। সেসবের তারিখ-স্থানসহ বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম।
গণফোরাম ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির কর্মসূচি: ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ এবং গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে, ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার-সিলেট রোডমার্চ, ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পেশাজীবী সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর-পটুয়াখালী রোডমার্চ, ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার ও ঢাকা জেলার আমিনবাজারে সমাবেশ, ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ রোডমার্চ, ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লায় জনসমাবেশ, ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ ও ৩০ সেপ্টেম্বর কৃষক-শ্রমিক সমাবেশ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ রোডমার্চ, ৩ অক্টোবর কুমিল্লা-ফেনী-মিরসরাই-চট্টগ্রাম রোডমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির নেতারা। এ ছাড়া আইনজীবীদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং আন্দোলনরত সব দল সমর্থন জানাবে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় দলটি।
পুলিশের পদোন্নতির তালিকায় থাকা পদ কাটছাঁট করায় অসন্তোষ কমছে না। এ নিয়ে পুলিশ কর্তারা একাধিক বৈঠক করছেন। প্রধানমন্ত্রী দেশে এলে পদোন্নতি নিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। পুলিশের অসন্তোষ ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগও নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে পদোন্নতির পদ আরও বাড়াতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে। চিঠি পেয়ে জনপ্রশাসনও কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, পদোন্নতির সংখ্যাটি প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কাটছাঁট করে পুলিশকে বিব্রত করেছে। অন্য ক্যাডাররা একের পর এক পদোন্নতি পেলেও পুলিশ পিছিয়ে আছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিব আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা হবে।
এদিকে ক্যাডারদের পাশাপাশি নন-ক্যাডারদেরও পদোন্নতির বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। ইতিমধ্যে সাব-ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতির উদ্যোগ নিতে পুলিশ সদর দপ্তর বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। পদোন্নতির তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তিন দিন আগে পদোন্নতি পেতে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। ওই সময় রাজধানীর ৫০ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতির বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের ক্যাডার ও নন-ক্যাডারদের পদোন্নতির বিষয়ে আমরা কাজ করছি। যাদের পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা আছে তারা অবশ্যই পদোন্নতি পাবেন। বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পদ বাড়াতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি শিগগির বিষয়টি সুরাহা হবে। নন-ক্যাডারদের কর্তারাও কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের বিষয়টিও সমাধান হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার পুলিশের জন্য যা করেছে, অতীতের কোনো সরকারই তা করেনি। পুলিশের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পুুলিশের পদোন্নতির তালিকা কাটছাঁটের বিষয়ে গত মঙ্গলবার আইজিপিসহ পুলিশ কর্মকর্তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওইদিন বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পুলিশের পদোন্নতির বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নুর-এ- মাহবুবা জয়া।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ রাষ্ট্রের আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাবাহিনী প্রধানতম বাহিনী, যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, পেশাদায়িত্ব ও শৃঙ্খলা রক্ষায় তদারকি ও ব্যবস্থাপনা এ বাহিনীর নেতৃত্বের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ বাহিনীকে নেতৃত্ব প্রদানে পুলিশ সুপার থেকে তদূর্ধ্ব পদে পর্যাপ্তসংখ্যক পদ এবং দক্ষ জনবল থাকা বাঞ্ছনীয়। পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (গ্রেড-৩) ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (গ্রেড-২) তুলনামূলক কম। বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোর আলোকে (বিদ্যমান পদে অতিরিক্ত) অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক এবং উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক পদোন্নতি দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হবে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদানের জন্য পদ সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিদ্যমান পদের অতিরিক্ত সুপারনিউমারারি পদ রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে সৃজনের প্রস্তাবে পদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) থেকে পুলিশ সুপার (এসপি) পর্যন্ত ৭২০ কর্মকর্তার পদোন্নতি পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। তালিকাটি সংশোধন করতে ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। পরে পুলিশ সদর দপ্তর ৫২৯টি পদ চূড়ান্ত করে আরেকটি তালিকা পাঠায়। সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দিতে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গত ১ আগস্ট এ প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় তালিকা কাটছাঁট করেছে। অতিরিক্ত আইজিপি পদে দুজন, ডিআইজি পদে ৫০ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে ১৪০ ও পুলিশ সুপার পদে ১৫০ জনকে পদোন্নতি দিতে ১৪ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন। পুলিশের তালিকায় ছিল অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-১) ১৫, অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-২) ৩৪, ডিআইজি ১৪০, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৫০ ও এসপি ১৯০ পদে পদোন্নতি দিতে। এ তালিকা কাটছাঁট হওয়ায় পুলিশে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ অসন্তোষ এখনো অব্যাহত আছে। অসন্তোষ ঠেকাতে আবার জনপ্রশাসনকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি দ্রুত সমাধান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পুলিশ সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, পুলিশে সংখ্যাতিরিক্ত (সুপারনিউমারারি) পদোন্নতিতে অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও এসপি পদে পদোন্নতির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৫২৯টি সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করতে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। পদোন্নতির বিষয়ে সিগন্যাল আসার পর ২০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে এ-সংক্রান্ত একটি সভা হয়েছিল। সভায় অতিরিক্ত সচিবসহ (পুলিশ ও এনটিএমসি) পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, পুলিশে বর্তমানে একজন অতিরিক্ত আইজিপির পদ খালি রয়েছে। সুপারনিউমারারি পদে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ১৫ ও ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১৮, ২০, ২১, ২২ ও ২৪তম ব্যাচের প্রায় সবাই ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি ২৭, ২৮ ও ২৯তম ব্যাচের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের এসপি হিসেবে পদোন্নতির বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নন-ক্যাডাররা পদোন্নতি পাবেন। সাব-ইন্সপেক্টর থেকে ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টর থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সুপারনিউমারারি পদে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মতোই নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হবে। ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কারা পাবেন তার তালিকা তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দাবিগুলো ছিল পুলিশ পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) ১০ বছর পূর্তিতে ষষ্ঠ গ্রেড দেওয়া। ১০ বছর পূর্তিতে ব্যাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রেড পরিবর্তন করা। ১০ বছরের মধ্যে পদোন্নতি না হলে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দেওয়া। সাব-ইন্সপেক্টরদের (এসআই) ক্ষেত্রেও একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে এসআই/সার্জেন্ট পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তাদের র্যাংক ব্যাজের নীল বা লাল ফিতা তুলে নেওয়া। কনস্টেবলদের বিভাগীয় পরীক্ষায় একবার পাস করলে সেখান থেকে প্রমোশন লিস্ট করে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে মন্ত্রীর কাছে।’
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪০-৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির অঙ্ক কষছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে, সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ৪০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রমুখী করতে পারলে নির্বাচন বিতর্ক সামাল দিতে কোনো বেগ পেতে হবে না।
আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেওয়া নানা পরিকল্পনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হলো ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। এ ছাড়া জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে নির্বাচন নিয়ে জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর আওয়ামী লীগ এ তিন পরিকল্পনাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান।
চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেন। এর আগে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল সফর করে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর আওয়ামী লীগে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বলে দাবি করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা।
তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিগত দুই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আওয়ামী লীগ তথা সরকারকে দেশ-বিদেশে বেশ বিপাকে ফেলেছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না সরকারি দল। সেজন্য আগে থেকেই আটঘাট বেঁধে নামতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না ধরেই কমপক্ষে ৪০ ভাগ ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়ে যাবে। সেই নির্বাচনে এ সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে এলে ভোটের পরে ভোট প্রশ্নবিদ্ধ করার যে চক্রান্ত বিএনপির রয়েছে, সেটি ব্যর্থ হয়ে যাবে। এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করার অন্যতম কারণ হলো এটি।
সরকারের ওপর অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের চাপ রয়েছে বিদেশিদের। গত আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন থেকে ফেরার পর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণ ভোট দিতে পারলেই সেটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, ৫০-৪০ শতাংশ ভোট কাস্টিং করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে আওয়ামী লীগ। তা সম্ভব হলেই ভোট বিতর্ক এড়ানো যাবে। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের পরে সব নির্বাচনেই ভোটার উপস্থিতি হতাশাজনক ছিল। এ বিষয়টি নিয়ে নানা সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠেছে। কোনো কোনো ফোরামে আলোচনায় সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে কম ভোটার উপস্থিতির উদাহরণ। তাই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্য নির্ধারণ করে নির্বাচন প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
দলের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে আসবে না এটা ধরে নিয়েই তিন পরিকল্পনায় সফল হতে পারবেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষে আওয়ামী লীগ মনে করে নির্বাচন পর্যন্ত জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য বেঁধে রাখা পারলেই নির্বাচন পর্যন্ত আর সমস্যাগুলো বড় বাধা হয়ে আসবে না সরকারের সামনে। বাকিটা হলো ভোটের দিন লক্ষ্য অনুযায়ী ভোটার উপস্থিতি ঘটানো।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তেমন আধুনিক উদ্যোগ নেই। কম ভোট উপস্থিতির এটিও একটি কারণ। প্রত্যেক ভোটারকে ভোট দিতে কেন্দ্রে আসতে হবে এমনকি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে, সেটি ইসিকে ভাবতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোও কেন্দ্রে ভোটার আনতে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। এ নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে কী কী উপায় নেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণা চলছে। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, স্বল্প সময়ে যে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা যায়, সেগুলো আগামী নির্বাচনে করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষের কর্মব্যস্ততা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কর্মব্যস্ত জীবনে সময় পেলে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার চেয়ে পরিবারকে একটু সময় দেওয়াকে বেশি গুরুত্বের মনে করেন ভোটাররা।’ ভোট দেওয়ার প্রবণতা পৃথিবীর অনেক দেশেই কমেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি দল নির্বাচনে না যাওয়ায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে মনে করে না ভোটাররা। ফলে নির্বাচন বর্জন করা দলের ভোটাররা কেন্দ্রে যান না এবং দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন এ ভেবে আওয়ামী লীগের ভোটাররাও যান না। গত নির্বাচনগুলোতে ভোট কম পড়ার বড় কারণ এগুলো। তবে আগামী নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সেগুলো নিয়ে কাজ করছেন তারা। জাফরউল্যাহ আরও বলেন, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেড়ে যাবে।’
আওয়ামী লীগের হিসাবে মোট ভোটারের প্রায় ৩৫ শতাংশই তাদের ভোটার। এবার দলীয় ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় দলটি।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ভোটার কেন্দ্রে আনার উদ্যোগ সফল হলে ভোট নিয়ে সব প্রশ্নই দূর করতে পারবে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ ও ’১৮ সালের দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্নের মধ্যে কম ভোটার উপস্থিতিও অন্যতম। তারা চান না এবার সেই প্রশ্ন উঠুক।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ছোট ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণেও ঘাটতি রয়েছে। ফলে সরকার বড় বড় কাজ করছে ঠিকই, ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণ করা সম্ভব হয়নি বলে সাধারণ জনগণের একটি অংশ সরকারের প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না, এমনটাই মনে করছেন তারা। তাই ভোটের আগে বাকি সময়ে ছোট বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তা পূরণ করা হলে সাধারণ জনগণের ওই অংশটি আওয়ামী লীগের ওপরই আস্থা রাখবে বলে তারা বিশ্বাস করেন।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সব শ্রেণির মানুষকে। সংসার জীবনের কশাঘাতে পড়ে সরকারের অবিশ্বাস্য উন্নয়ন ওই শ্রেণির মানুষের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না। সংসার সামলাতে যে বিষয়গুলো বেশ বেগ পেতে হচ্ছে সেগুলোকে নির্বাচন পর্যন্ত কড়া মনিটরিংয়ে রেখে সামাল দেওয়া সম্ভব হলে মধ্যবিত্ত/নিম্নবিত্ত অংশের আস্থা অর্জন করতে পারবে বলে তারা মনে করছেন। আর আস্থা অর্জন করতে পারলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলে তাদের বিশ্বাস।
জনআকাক্সক্ষা পূরণের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে বারবার একই চেহারা দেখছেন এলাকার মানুষ। অন্যদিকে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে প্রতিবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন নির্বাচিত ওই জনপ্রতিনিধি। তাতে মানুষ বিরক্ত হন। এলাকার ভোটাররা মনে করেন, একজনকে কতবার ভোট দেব? এটি হলো জনআকাক্সক্ষা। এ জায়গায় নতুন মুখ নিয়ে আসা সম্ভব হলে মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা জাগবে। রাজনীতিতে সক্রিয় নন, এমন লোকজনও আগ্রহী হবেন। নতুন প্রার্থীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে ভোটাররা আসবেন।
এদিকে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি বিপাকে পড়েছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়ে যাবে এ বিষয়টি বিএনপির কাছেও পরিষ্কার হয়ে গেছে। নির্বাচন সময়মতো হয়ে যাবে এটা এখন বিএনপিও বিশ্বাস করে। দলটি ভাবছে, আন্দোলন জমছে না, নির্বাচনও ঠেকানো যাবে না। আর সেটাই তাদের বিপাকের কারণ।’
রুবেলা বা জার্মান মিজেলস একটি সংক্রামক রোগ। এটি রুবেলাভাইরাস থেকে হয়ে থাকে। একে জার্মান হাম বা তিন দিনের হামও বলা হয়। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগ। করোনা ভাইরাসের মতই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকেই এই রোগ ছড়ায়। গর্ভাবস্থায় এই রোগ গর্ভস্থ শিশুর নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
রুবেলা সাধারণত ভাইরাসের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির ড্রপলেটসের মাধ্যমে বাতাসে ছড়ায় এবং পরবর্তীতে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে আরেকজনকে আক্রান্ত করে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের রুবেলাভাইরাস হতে পারে।
তবে একবার এই রোগটি হয়ে গেলে সাধারণত স্থায়ীভাবে আর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
রুবেলার লক্ষণ বোঝা করা কঠিন, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। কারণ রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে ভাইরাসটি রোগীর দেহে সাত থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে।
এই রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ সাধারণত ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায় এবং সাধারণত ১ থেকে ৫ দিন স্থায়ী হয়।
হালকা জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮.৯ C) বা তার কম
মাথাব্যথা
নাকে সর্দি বা বন্ধ নাক।
চোখ লাল হয়ে যাওয়া ও চুলকানি হওয়া।
মাথা ও ঘাড়ের পেছনের গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা হওয়া, কানের পিছনের লিম্ফ নড পিণ্ডর মতো ফুলে যাওয়া
লাল বা গোলাপি ফুসকুড়ি যা মুখে শুরু হয় এবং দ্রুত ঘাড়, শরীর, বাহু ও পায়ে ছড়িয়ে পড়ে
জয়েন্টগুলোতে ব্যথা, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে
হাঁচি-কাশি এবং নাক দিয়ে পানি পড়া
শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা
ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা
রুবেলাভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে। এটি সাধারণত চিকিৎসা ছাড়াই ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
এমনকি গর্ভবতী নারী আক্রান্ত হলে মা বা শিশুর ও কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে গর্ভবতী নারী রুবেলা আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে এলে তাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়া যেতে পারে। তাই রুবেলাকে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা খুব জরুরি।
তবে একবার আক্রান্ত হলে সে সময় যা যা করতে হবে,
১. যেহেতু রোগটি অনেক ছোঁয়াচে তাই আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হবে।
২. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে এবং আক্রান্ত হলে কঠোর পরিশ্রমের কাজ না করাই ভালো
৩. সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে
৪. ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ যুক্ত ফলমূল খেতে হবে বেশি করে।
৫. প্রতিদিন গোসল করাতে হবে, শরীরে জ্বর থাকলে ভেজা কাপড় একটু পর পর শরীর মুছতে হবে।
৬. কোনও ওষুধ খাওয়ানোর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
কেউ যদি গর্ভাবস্থায় রুবেলায় আক্রান্ত হন তবে রুবেলা অনাগত শিশুর ক্ষতি করার পাশাপাশি গর্ভপাতের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ছাড়া শিশুর জন্মের পরে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
হার্টের ত্রুটি
ছানি
বধিরতা
বিলম্বিত শেখা
লিভার এবং প্লীহার ক্ষতি
ডায়াবেটিস
থাইরয়েড সমস্যা
রুবেলার সুনির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা না থাকায় টিকা হলো উত্তম প্রতিষেধক। এই রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল হাম-মাম্পস-রুবেলা (এমএমআর) টিকার দুই ডোজ টিকা প্রয়োগ। সব বয়সেই এই টিকা নেয়া যায়।
টিকার প্রথম ডোজটি সাধারণত শিশুর নয় থেকে ১৫ মাসের মধ্যে দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয় শিশুর সাড়ে তিন থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্করা এই টিকা নিতে পারেন। সাধারণত প্রথম ডোজ নেয়ার কমপক্ষে এক মাস থেকে তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়।
কিশোরীদের ১৫ বছর বয়সে টিটি টিকার সঙ্গে এক ডোজ হাম-রুবেলা টিকা দিতে হয়। এ ছাড়া গর্ভধারণে ইচ্ছুক নারীদের রুবেলা অ্যান্টিবডি টেস্ট করে প্রয়োজন হলে ৩ মাস ব্যবধানে ২ ডোজ টিকা দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা পরবর্তী এক মাসের মধ্যে সন্তান নিতে নিষেধ করা হয়।
১. অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। কেউ হাঁচি-কাশি দিলে তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হবে।
২. হাত সবসময় সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার রাখতে হবে।
৩. নাকে, চোখে, মুখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪. কাশি বা হাঁচি আসলে সে সময় টিস্যু ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহৃত টিস্যু ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে।
৫. যাদের শরীরে ফুসকুড়ি বা র্যাশ জাতীয় আছে তাদের সাথে শারীরিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে।
৬. অতিরিক্ত ভীর বা জনসমাগম এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।