খাজা টাওয়ারে, একই ভবনে এত আইআইজি বা একই জাতীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কারিগরি স্থাপনার সহাবস্থান, যার ওপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত- বিষয়টি ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে হয়তোবা বেশ দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু প্রযুক্তির ভাবনা থেকে নির্দ্বিধায় বিপজ্জনক।
অন্যান্য দিনের মতোই মহাখালীর খাজা টাওয়ারের তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের ছিল যথারীতি ব্যস্ততা। দেশের শীর্ষস্থানীয় নেটওয়ার্কগুলোর তীর্থস্থান বলা চলে এই জায়গাটিকে। কী নেই এখানে? সার্ভার রুমগুলোতে বেশ কয়েকটি বড় বড় করপোরেটদের সার্ভার রয়েছে। পোশাকি ভাষায় যার নাম ‘ডাটা সেন্টার’। এ ছাড়া ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার বা আইএসপিদের সুইচ রুম এমনকি একাধিক টেলিকম অপারেটর বা মোবাইল ফোন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু যন্ত্রপাতি আছে এই বিল্ডিংয়ে। দুপাশ থেকে চেপে আসা দুটো ভবনের মধ্যখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে খাজা টাওয়ার। যার মাথার ওপর রয়েছে নানা রকম অ্যান্টিনা। পুরো দালানের ভেতর-বাহির যেখানেই যেভাবে জায়গা পেয়েছে, সেখানেই ছড়িয়ে আছে নেটওয়ার্ক আর কারেন্টের তার। মাকড়সার জালের মতো পুরো দালানে রয়েছে হাজারো নেটওয়ার্ক কানেকশন আর শত শত সার্ভার, সুইচ, রাউটারসহ কারিগরি যন্ত্রপাতি। ত্যপ্রযুক্তির জটিল অবকাঠামো বা ইনফ্রাস্ট্রাকচারে ব্যবহৃত এসব যন্ত্রপাতিকে ঠাণ্ডা রাখতে চলছিল অতি উচ্চমাত্রার এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম আর সেই সঙ্গে ছিল হাজার হাজার ব্যাটারি সম্পৃক্ত বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা বা ইউপিএস। বিল্ডিংয়ের প্রায় অফিসেই ছিল প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। তবে ভবনটির সরু সিঁড়ি জানিয়ে দেয়, ১৪তলা এই দালানে কখনো কোনো অঘটন ঘটলে বের হয়ে আসতে কতটা কষ্ট হবে সবার।
ঘটনা শুরু বিকেল ৫টা নাগাদ। পূজার ছুটি শেষে আগের দুদিনে রাস্তাঘাটে ভিড় তেমন জমে ওঠেনি। আর হেমন্তের বিকেলের হালকা হিমেল হাওয়া বইছে নগরে। এই দুই মিলে নগরবাসীর একটা অংশ বেশ ফুরফুরে মেজাজেই ছিল গত বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর ২০২৩)। একে সপ্তাহের শেষ দিন তারপর রাস্তাঘাটে ভিড় কম, অনেকেই হয়তো পরিকল্পনা করছিল তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যাওয়ার। দু-চারজন হয়তোবা অকারণেই ফেসবুকে স্ক্রলিং করছিলেন। এমনি সময় খাজা টাওয়ারের একদম ওপরের দিকে আগুনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এঁকেবেঁকে থাকা নানা ধরনের তার আর দাহ্য পর্দা দিয়ে তৈরি ইন্টেরিয়রকে অবলম্বন করে আগুন ছড়িয়ে পড়তে খুব একটা বেশি সময় লাগেনি। আতঙ্ক আর আগুনের তাপ সহ্য করতে পেরে অনেকেই নেমে আসেন সরু সিঁড়ি দিয়ে, কেউ কেউ ঝুলে পড়েন ভবনের বাইরে থাকা বিভিন্ন ধরনের তার ধরে। এত কিছু করেও শেষ রক্ষা হয়নি। অগ্নিকাণ্ডে দুই নারীসহ মৃত্যু হয় ৩ জনের।
তবে আজকের আলোচনা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়ে নয়। এমনকি আলোচনা হবে না, কীভাবে আগুন লাগল বা কী করলে ক্ষয়ক্ষতি কম হতো সেসব নিয়ে। বলব, প্রযুক্তির প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমরা কতটুকু সংবেদনশীল বা বিকল্প প্রযুক্তি স্থাপনা তৈরিতে আমরা আদৌ যতœবান কিনা?
সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দিয়ে পরিপূর্ণ খাজা টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, পরিকল্পনার দুর্বলতা রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির স্থাপনা এবং অবকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে। পরিকল্পনায় ত্রুটিগুলোকে দেখতে হলে প্রথমে একটু বুঝে নিতে হবে যে, কীভাবে আমাদের ইন্টারনেটের সংযোগ ব্যবহারকারীদের কাছে এসে পৌঁছায়? মূলত দুই ধরনের ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছেন। এক ধরনের ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন আর অন্যরা ব্যবহার করেন ব্রডব্যান্ডের সাহায্যে। মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করার ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন সংযোগ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান আইএসপি বা ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারে কাজটি করে াকে আর ব্রডব্যান্ড সংযোগের ক্ষেত্রে লাইসেন্সপ্রাপ্ত একটি আইএসপি অফিস বা বাসায় একটি সংযোগ প্রদান করেন। এসব আইএসপিদের কেউই সরাসরি ইন্টারনেটে কানেক্টেড না। তারা পাইকারি দরে ইন্টারনেট কিনে থাকে ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে অপারেটর বা আইআইজির কাছ থেকে। দেশে বিশটির বেশি আইআইজি রয়েছে। আইআইজির সঙ্গে সংযুক্ত থাকে সাবমেরিন কেবল এবং ক্ষেত্রবিশেষে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট কানেকশন।
খাজা টাওয়ারে ছিল অনেক আইআইজির ডাটা সেন্টার। মূলত এখান থেকেই বিভিন্ন আইএসপি এবং মোবাইল ফোন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে ইন্টারনেট দেওয়া হতো। প্রথম দফায় খাজা টাওয়ারে অবস্থিত আইআইজিগুলোর মধ্যে নয় থেকে দশটি প্রতিষ্ঠান শাটডাউন হয়ে যায়। পরবর্তী সময় দু-একটি প্রতিষ্ঠান বিকল্প স্থান থেকে সেবা চালু করে। একই ভবনে এতগুলো আইআইজি বা একই জাতীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কারিগরি স্থাপনার সহাবস্থান, যার ওপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেশের ত্যপ্রযুক্তি খাত বিষয়টি ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে হয়তোবা বেশ দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু প্রযুক্তির ভাবনা থেকে নির্দ্বিধায় বিপজ্জনক। এক বিবৃতিতে কয়েকটি আইআইজি ফোরামের মহাসচিব আহমেদ জুনায়েদ জানান, বেশ কয়েকটি আইআইজি (লেভেল থ্রি, ম্যাক্স হাব, আমরা নেটওয়ার্কস, আর্থনেট, ভার্গো ও উইনস্ট্রিম ইত্যাদি) পুরোপুরি শাটডাউন হয়ে গেছে। একই সঙ্গে দেশের ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবির সভাপতি এমদাদুল হক আশঙ্কা প্রকাশ করেন, সারা দেশের মোট ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ৪০ শতাংশ ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে ভোগান্তিতে পড়েছে।
একটু বিশদে কৌশলগত আলোচনা করা যাক। মনে করুন, কোনো একটি প্রতিষ্ঠান নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়ার জন্য দুটো আইএসপি থেকে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়েছে। এই দুটো আইএসপি আবার তাদের নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করার জন্য দুটো দুটো চারটি আইআইসি থেকে ইন্টারনেট সংযোগ সংগ্রহ করেছে বা পাইকারি করে ইন্টারনেট কিনছে। এত ধরনের বিকল্প চিন্তা করার পরও এই চারটি আইআইজি যদি একই বিল্ডিংয়ে বা এলাকায় অবস্থিত হয় তাহলে ওই বিল্ডিংটি বা এ এলাকা কোনোভাবে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেলে সম্পূর্ণ ইন্টারনেট সংযোগটি ব্যাহত হয়। আর এই ঘটনাটিই ঘটেছে এ ক্ষেত্রে।
শুধু ইন্টারনেট সংযোগ প্রদানকারী সংস্থা নয়, বিভিন্ন টেলিফোন অপারেটরদের মধ্যে আন্তঃসংযোগ নিশ্চিত করার জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে থাকে (ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ বা আইসিএক্স) সেগুলোর বেশ কয়েকটির অবস্থান ছিল খাজা টাওয়ারে। ফলে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী এক অপারেটর থেকে অন্য অপারেটরে কল করার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু বিড়ম্বনায় পড়ছেন। আরও জানা গেছে, দুটি টেলিফোন অপারেটরের বড় ধরনের সুইচিং সিস্টেম অবস্থা ছিল এখানে, ফলে শহরের বিভিন্ন জায়গায় মুঠোফোনের সংযোগ নিয়োগ কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়েন মোবাইল সংযোগ ব্যবহারকারীরা। এর বাইরে ক্লাউড সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে একটি প্রতিষ্ঠান এবং একটি ব্যাংকের ডাটা সেন্টার অবস্থিত ছিল এই বিল্ডিংয়ে। আউটসোর্সিংয়ের কাজে জড়িত অনেকেই তাদের সার্ভারগুলো রেখেছিলেন এই ভবনে। অগ্নিকা-ের জের হিসেবে তারা তাদের দেশ-বিদেশের একাধিক ক্লায়েন্টকে প্রযুক্তিসেবা দিতে পারছেন না। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বা বিটিআরসির লক্ষ্য রাখা উচিত, একই স্থাপনায় বা কাছাকাছি লোকেশনে যেন একাধিক আইআইজি অবস্থান করার বিষয়টি। এ ছাড়া বিকল্প ডাটা সেন্টার বা ব্যাকআপ সাইটের বিষয়ে ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। শুধু ব্যাকআপ সাইট থাকলেই চলবে না। ব্যাকআপ সাইটে যথাযথভাবে সেবা এবং সংযোগ প্রদানের সক্ষমতা থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রায় সব আইআইজি র্ব্যতার পরিচয় দিয়েছে।
একই কথা ক্লাউড প্রযুক্তিসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে। ক্লাউড সার্ভিস প্রোভাইডারদের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, ক্লাউড সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে যারা কাজ করছে তাদের বেশিরভাগই এখন পর্যন্ত শুধু একটি সাইটে তাদের ক্লাউড সার্ভিসকে একটিভ রেখেছেন। অর্থাৎ তাদের প্রাইমারি সার্ভার রুমে কোনো সমস্যা হলে সেকেন্ডারি বা ব্যাকআপ সার্ভার রুম থেকে তারা সেবা প্রদান করতে এখনো সক্ষম নয়। যদিও ক্লাউডসংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড (বিশেষ করে আইএসও ২৭০১৭ এবং ২২৩০১), জাতীয় ক্লাউড কম্পিউটিং নীতিমালা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইনসহ বিভিন্ন ধরনের দলিলপত্রে একাধিক সার্ভার রুম বা ডাটা সেন্টার রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আর ক্লাউড সার্ভিসের সাধারণ সংজ্ঞা যদি আমরা দেখি, তাহলে তো নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করা ক্লাউড সার্ভিস প্রোভাইডারের মূল দায়িত্ব। একই স্থানে এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিস প্রোভাইডারের অবস্থান যদি চলতে থাকে, তাহলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবেই। এ ক্ষেত্রে একাধিক সাবমেরিন কেবল আর বর্ডার ক্রসিং টেরিস্টেরিয়াল অথবা স্যাটেলাইট সংযোগ কোনো কিছুই কাজে আসবে না।
লেখক: ব্লগার ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ