বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানই সরকারের কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেছেন, ‘অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করতে কর হার বেঁধে দেওয়া আমরা কোনোভাবেই সমর্থন করি না। এই হার অবশ্যই গ্রাহকের সম্পদের পরিমাণের ওপর হওয়া উচিত।’ ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে দেওয়া কর ন্যায্যতার খেলাপ বলে মনে করেন তিনি।
গতকাল শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইডিএসের সেমিনার কক্ষে প্রথমবারের মতো বাজেট পর্যালোচনার আয়োজন করা হয়। এতে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়।
বাজেট প্রস্তাবে আগামী জুলাই মাস থেকে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে এক বছরের জন্য কালো টাকা সাদা বা বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বিনায়ক সেন বলেন, বিভিন্ন কারণে গ্রাহকের বৈধ আয়ও অপ্রদর্শিত আয় হতে পারে। এক্ষেত্রে অপ্রদর্শিত আয়কে প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া দরকার। তবে অপ্রদর্শিত আয়কে প্রদর্শনের সুযোগে একেবারে কর মওকুফ করা কিংবা একটি নির্দিষ্ট হার বেঁধে দেওয়ার পক্ষে নই আমরা। আমাদের অবস্থান মধ্যবর্তী।
তিনি বলেন, গ্রাহকের কাছে যে পরিমাণ অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থ থাকবে সেই সম্পদের পরিমাণ অনুযায়ী কর নির্ধারণ করা উচিত। সেটা হতে পারে ১৫ শতাংশ, আবার হতে পারে ২০, ৩০ বা ৩৫ শতাংশ।
ঋণখেলাপি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ চার বার দেওয়া উচিত না। এটা আগে দুই বার ছিল। চার বারে এটা ১২ বছর হয়ে যায়। এ সময়ে অর্থনীতির অবস্থা বদলে যায়। তাই এই দীর্ঘ সময়ে ঝুঁকি তৈরি হয়। কেন আমরা অযথা এ ঝুঁকি নেব?
বিনায়ন সেন বলেন, বাজেটে একটি বিষয়ে এবার গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল। এলডিসির পর আর আমাদের শুল্ক সুবিধা থাকবে না। তাই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের দ্রুত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করা দরকার। সেটা এখন প্রসেসিং করলেও ৮-১০ বছর লেগে যাবে। এখন না করলে পরে সমস্যায় পড়তে হবে।
বর্তমান ডলার সংকট মোকাবিলায় শুধু আইএমএফের দ্বারস্থ না হয়ে অন্যান্য সংস্থা বা দেশের সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। সংকট কাটাতে দীর্ঘস্থায়ী পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক করা দরকার বলেও তিনি মনে করেন।
সভায় সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে কথা বলেন বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন। তিনি বলেন, সরকার এবার মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বাজেট প্রস্তাব করেছে। এতে যেমন কৃচ্ছ্র সাধন করা হয়েছে, আবার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও রাখা হয়েছে।
মনজুর হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ জ্বালানির দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি মাথায় রাখা দরকার। তা না হলে জ্বালানির দাম মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে। তিনি মূল্যস্ফীতি কমাতে রাশিয়া, চীন থেকে স্বল্প দামে জ্বালানি আনা যায় কি না সেটা দেখার আহ্বান জানান। বাজার স্বাভাবিক না হলে ডলার রেট আরও বাড়বে, যা মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেবে বলেও তিনি মনে করেন।
বাজেটে শিক্ষা-স্বাস্থ্যে সামান্য বরাদ্দ বাড়লেও এসব খাতে মানসম্মত সেবা বাড়ানোর কোনো দিকনির্দেশনা নেই এ বিষয়ে জানতে হলে বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. এস এম জুলফিকার আলী বলেন, এসব খাতে সেবার মান বাড়ানোর প্রয়োজন আছে। এছাড়া তাদের বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা দরকার। শুধু অবকাঠমো নির্মাণ না করে সেবার দিকে জোর দেওয়া দরকার। যে যন্ত্রপাতি আছে তা দিয়েই সেবা দেওয়া উচিত। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বাড়ানো দরকার। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাপটপ দেওয়া হয়। সেটা ব্যবহার হয় না, পড়ে থাকে। এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
বিআইডিএসের সভায় বক্তারা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থনীতির মধ্যমেয়াদি পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়, সুদ হারে সীমা তুলে নেওয়া, নিয়ন্ত্রিতভাবে বাজেটের আকার বৃদ্ধি ও সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানোর মতো বিষয়ে আলোকপাত করেন। এ ক্ষেত্রে মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় রাখা হয়েছে। তবে মধ্যমেয়াদি এসব নীতির সুফল পেতে সরকারকে সময় দিতে হবে।