আওয়ামী লীগ সরকারের টানা চার মেয়াদের তিন বারই সংসদ সদস্য ও একবার সংসদের হুইপ ছিলেন সামশুল হক চৌধুরী ওরফে বিচ্ছু। সে সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতি,জমি দখল-বেদখল, বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্য, মানুষ নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার নির্যাতন থেকে দলীয় নেতাকর্মীরাও রক্ষা পেতেন না বলে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী।
জানা যায়, এক সময় যুবদল পরে জাতীয় পার্টি করা সামশুল হক চৌধুরী রাতারাতি আওয়ামী লীগের নেতা বনে যান। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের জোয়ারের সময় যাদুর কাটির ইশারায় মনোনয়ন ভাগিয়ে নিয়ে সহজে হয়ে যান এমপি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর টানা তিন বার সংসদ সদস্য হন তিনি। তৃতীয় মেয়াদে সংসদ সদস্য হওয়ার পর জাতীয় সংসদের হুইপ হয়ে চমক সৃষ্টি করেন তিনি। অবশ্যই তার নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আসায় চতুর্থ মেয়াদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হন তিনি।
গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীর নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ঈগল প্রতীকে নির্বাচন করে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন সামশুল হক চৌধুরী। নির্বাচন চলাকালীন কয়েক দফা দলের ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়েছিলেন তিনি।
উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজেদা বেগম জানান, দলীয় নেতাকর্মীদের চাঁদার টাকায় নির্বাচন করে প্রথমবার এমপি হওয়ার পর তাদের আর চিনতেন না তিনি। তার সিদ্ধান্তের সাথে একমত না হলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরও রেহাই দিতেন না তিনি । তার পাহাড় সম অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে যারা কথা বলতেন তাদের উপর নেমে আসতো অত্যাচার নির্যাতনের খড়গ। তার ভয়ে তটস্থ থাকতেন পটিয়াবাসী। বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি থেকে দলে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে কোণঠাসা করে গড়ে তুলেন নিজস্ব বলয়। উন্নয়নের নামে জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ খাতেও কয়েক কোটি টাকা দুর্নীতি করেছেন তিনি।
সামশুল হক চৌধুরীর রোষানলের শিকার কারা নির্যাতিত নেতা পটিয়া উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ন আহবায়ক ডি এম জমির উদ্দিন জানান, ‘তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের অবহেলা ও মামলা মোকদ্দমা দিয়ে হয়রানি করেছেন। এমনকি পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে আহত করার নজিরও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার ভাই,বোন,ছেলে, ভাগিনা, আত্মীয়-স্বজন সহ গুটি কয়েক আওয়ামী লীগ নেতাকে নিয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। সিন্ডিকেটের সদস্য এক আওয়ামী লীগ নেতাকে চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ (পটিয়া) এর চেয়ারম্যান করে তার মাধ্যমে পল্লী বিদ্যুৎ থেকে কয়েক শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। পরে অবশ্যই ঐ নেতা অনিয়ম দুর্নীতির কারণে আজীবনের জন্য পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে বহিষ্কার হন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিচ্ছুর সময়ে সকল খাতে ঘুষ-দুর্নীতি ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’। শুধু তাই নয়, তার সিন্ডিকেটের কব্জায় ছিল মাছের ঘের ও গবাদি পশুর খামার। ক্যাসিনো ব্যবসায়ও টাকা কামিয়েছেন তিনি সমানতালে। মিডিয়ায় ক্যাসিনোর পক্ষে মন্তব্য করে সারাদেশে ভাইরাল হয়েছিলেন সামশুল হক চৌধুরী বিচ্ছু। টেন্ডারবাজী ও বালু মহাল নিয়ন্ত্রণ করে কয়েক হাজার কোটি টাকার হরিলুটের বিষয়টি এখন সকলের মুখে মুখে। এই সিন্ডিকেট পুরো পটিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জায়গা জমি দখল-বেদখল, বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্যের এক বিশাল রাজত্ব কায়েম করে।
উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব খোরশেদ আলম জানান, ‘গত ১৫ বছরে সামশুল হক চৌধুরী বিচ্ছু মামলা-হামলা ও গ্রেফতার করে আমিসহ আমাদের অগনিত নেতাকর্মীদের নির্যাতন করেছেন। মালিয়ারা ও হরিণখাইনের দুটি হত্যা মামলায় আমাদের নেতা এনামুল হক এনামসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জড়িয়ে হয়রানি করেছেন। তিনি মেগা উন্নয়নের নামে মেগা হরিলুট করেছে। গত সরকারের সময় সামশুল হক চৌধুরীর অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ঐ সময় তার সরকার ক্ষমতায় থাকায় সরকারের উচ্চ মহল থেকে দুদককে চাপ সৃষ্টি করে মামলা থেকে অব্যাহতি নেন তিনি। মেগা হরিলুট সহ সামশুল হক চৌধুরী বিচ্ছুর সকল অনিয়ম দুর্নীতি দুদকের মাধ্যমে পুন: তদন্ত করতে হবে।’
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন জানান, ‘সামশুল হক চৌধুরী বিচ্ছুর অনিয়ম দুর্নীতি সমর্থন না করায় সম্মেলনের মাধ্যমে কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রাশেদ মনোয়ার ও (আমি) সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিনের কমিটি ভেঙে আ ক ম সামশুজ্জামানকে সভাপতি ও অধ্যাপক মো. হারুনর রশীদকে সাধারণ সম্পাদক করে তার আজ্ঞাবহ কমিটি গঠন করা হয়। তার নির্দেশে এই আজ্ঞাবহ কমিটি এক রাতে পটিয়ার ১৭ টি ইউনিয়ন ও ১ টি পৌরসভার কমিটি এক কলমের খোঁচায় ভেঙে প্যাড সর্বস্ব প্রেস রিলিজের মাধ্যমে পকেট কমিটি ঘোষণা করেন । সংসদ সদস্য ও পরবর্তিতে প্রতিমন্ত্রীর মর্যদায় হুইপ হয়ে গত ১৫ বছর তিনি বেশ বেপরোয়া ছিলেন। তার হাত থেকে রেহাই পাননি নিজ দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরাও। দলের সুসময়ে মধু খেয়েছেন সামশুল হক চৌধুরী বিচ্ছু। দু:সময়ের ত্যাগী নেতাকর্মীদের কোন মূল্যায়ন করেননি তিনি।’