দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগের পরও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে সুপারিশ করেছে বেবিচক। তবে শেষ পর্যন্ত ‘দুর্নীতির গন্ধ’ থাকায় তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া ঝুলে যাচ্ছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। কোন পদ্ধতিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ? এ মর্মে বেবিচক বোর্ডসভার কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
বছরখানেক আগে নানা মহলে তদবির করে পদোন্নতি পেয়েছেন প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান। চলতি মাসের ২৩ তারিখ তার অবসরে যাওয়ার কথা রয়েছে। তবে অবসরে যাওয়ার আগেই ভাগ্যের পরিবর্তন করতে উঠে পড়ে লেগেছেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে তিনি অন্তত ১০ কোটি টাকার বাজেট করেছেন। এ নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেশ রূপান্তর।
জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিমান ও সিএ) আব্দুন নাসের খান গতকাল মঙ্গলবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কোনো দুর্নীতিবাজকে আমরা আশ্রয়-প্রশ্রয় দেব না। মন্ত্রণালয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। বেবিচকের বেশ কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে। সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলীর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাবটি এখনো আমাদের কাছে আসেনি। যদি আসে দুর্নীতির বিষয়টি গভীরে গিয়ে পর্যালোচনা করা হবে। কোনো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা বা কর্মচারী মন্ত্রণালয় থেকে সাপোর্ট পাবে না। একই মন্ত্রণালয়ের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দুর্নীতির মামলা থাকার পরও কোন ভিত্তিতে বেবিচকের বোর্ডসভা প্রধান প্রকৌশলীকে এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করেছেÑ তার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। প্রধান প্রকৌশলীকে নিয়ে পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় আমরা বিব্রত। বিষয়টি সরকারের হাইকমান্ডকে অবহিত করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাবিবুর রহমানকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে বেবিচকের কয়েকজন কর্মকর্তা নানা উপায়ে চেষ্টা করছেন বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। হাবিবুর রহমান যদি স্বচ্ছ লোক হয়ে থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা কেন হলো সেই প্রশ্ন আমাদের কাছে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিষয়টি তদন্ত করছে মন্ত্রণালয়।’
এদিকে প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে চারটি মামলা থাকায় তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যায় কি নাÑ এমন মতামত চেয়ে দুদক চেয়ারম্যানের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন বেবিচক চেয়ারম্যান।
নাম প্রকাশ না করে বেবিচকের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বোর্ডসভায় হাবিবুর রহমানকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাবটি স্বাভাবিকভাবে নেয়নি মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে তারা আমাদের কাছে ব্যাখ্য চেয়েছেন। কিন্তু আমাদের কয়েকজন বড় কর্তা যেভাবেই হোক তাকে নিয়োগ দিতে চাচ্ছেন।
বেবিচক সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, গত ৩ মার্চ বেবিচক কার্যালয়ে বোর্ডসভায় প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানকে এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করে। দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্তটি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মেনে নিতে পারেননি। দুদকের মামলার হওয়ার পাশাপাশি তাকে সরাতে উচ্চতর আদালতে রিট পর্যন্ত করা হয়েছিল। তিন দিন আগে তার অপসারণ চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগও দেওয়া হয়েছে। বোর্ডসভার সিদ্ধান্তটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আমলে না নিয়ে ভিন্ন কাউকে নিয়োগ দেওয়া যায় কি না, বেবিচককে বলা হয়েছে।
বেবিচক সূত্র জানায়, হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ আছে। টেন্ডারের কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ৫ লাখ টাকার ঘুষ নিয়েও কাজ না দেওয়ায় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকীসহ বেবিচকের ১৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই মামলায় বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান ও সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আবদুল মালেকের নাম রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, আসামিরা যেন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারেন, সেজন্য বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে হাবিবুর রহমানের চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে আবারও দুই বছরে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে নানা মহলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। গত ২৬ জানুয়ারি সংস্থাটির চেয়ারম্যানের কাছে আবেদনও করা হয়েছে। আবেদনের নথি নাম্বার-৩০.৩১.০০০। এ নিয়ে পুরো বেবিচকে তোলপাড় শুরু হয়েছে। গত সরকারের আমলেও সংস্থাটির সাবেক প্রধান আবদুল মালেকের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় দুদক তদন্ত করে। তার চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ম্যানেজ করে এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ভাগিয়ে নেন।
বেবিচক সূত্র জানায়, বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় প্রকৌশল বিভাগ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি দীর্ঘদিন বেবিচকের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কাজ করেছেন। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় দুদক তদন্ত করে। অভিযোগে বলা হয়েছে, বেবিচকের যত মেগা প্রকল্প রয়েছে, প্রায় সবগুলোতেই অর্থ-বাণিজ্য করেছেন তিনি। অনিয়ম হালাল করতে রাতারাতি টেন্ডারের নিয়ম পাল্টে ফেলেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিনা টেন্ডারে ১৬ কোটি টাকার কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন কাজে পিডি থাকার সময় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের প্রমাণ পায় মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। পরে তাকে পিডির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করে বেবিচকের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত সরকারের আমলে হাবিবুর রহমান ভালো অবস্থানেই ছিলেন। তিনি কখনো খারাপ স্থানে ছিলেন না। কিন্তু এখন তাকে আওয়ামী লীগবিরোধী বানিয়ে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। গত সরকারের আমলে সিভিল সার্কেল-১-এর দায়িত্বে থাকাকালে দুর্নীতি ও খামখেয়ালিপনার প্রমাণ মেলায় তাকে বেবিচকের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব নির্দেশনা উপেক্ষা করে অদৃশ্য কারণে তাকে একের পর এক মেগা প্রকল্পে পিডির দায়িত্ব দেওয়া হয়। যার মধ্যে রয়েছে খুলনার খানজাহান আলী বিমানবন্দরের উন্নয়ন, সৈয়দপুর বিমানবন্দরের উন্নয়ন, সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলেকরণ ও নতুন টার্মিনাল নির্মাণ, চট্টগ্রামে শাহ আমানত বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলেকরণ এবং প্যারালাল ট্যাক্সিওয়ে নির্মাণ, রানওয়ে সম্প্রসারণ ও বিদ্যমান টার্মিনাল সম্প্রসারণ-নবরূপায়ণ এবং কক্সবাজার বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ ও রানওয়ে সম্প্রসারণ কাজে। যদি তিনি গত সরকারের আস্থাভাজন না হতেন তাহলে কি এসব বড় বড় প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করতে পারতেন?
জানা গেছে, প্রকৌশল বিভাগের সাবেক প্রধান আবদুল মালেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় দুদক তদন্ত করে। তিনিও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তারিক আহমেদ সিদ্দিকীকে ম্যানেজ করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে যান। এ নিয়েও বেবিচকে সমালোচনার ঝড় ওঠে। গত ২৭ জানুয়ারি ৮১২ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় আবদুল মালেক ও হাবিবুর রহমানসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা করে দুদক। তাছাড়া মামলার আট আসামি যেন দেশত্যাগ করতে না পারেন সেজন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত। এত অভিযোগ থাকার পর গত ২৬ জানুয়ারি হাবিবুর রহমান দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে আবেদন করা হয়। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে করা আবেদনে হাবিবুর রহমানকে নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা আখ্যায়িত করা হয়েছে। তার দীর্ঘ কর্মজীবনে কক্সবাজার বিমানবন্দর (প্রথম পর্যায়) প্রকল্প, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদ্যামান রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ের শক্তিবৃদ্ধিকরণ প্রকল্প, সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ের শক্তিবৃদ্ধিকরণ প্রকল্পসহ আরও ছোট-বড় প্রকল্পের পরিচালক পদে নিষ্ঠা ও সাফল্যের সঙ্গে পালন করেন। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য আটটি ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, হাবিবুর রহমানের অবসর ছুটি বাতিলপূর্বক ২৩.০৩.২৫ তারিখ হতে ২২.০৩.২৭ পর্যন্ত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে।