জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ; কোটি কোটি মানুষের আকুতি, প্রার্থনা; সর্বোচ্চ পর্যায়ের চিকিৎসা সবই বৃথা গেল। বাঁচানো গেল না মাগুরায় পাশবিক নির্যাতনের শিকার তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া আট বছরের কন্যা শিশুটিকে। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেল শিশুটি।
গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ সময়ে এই মৃত্যুসংবাদ বিষাদে ছেয়ে ফেলে পুরো দেশকে। শিশুটির মৃত্যুতে নানা শ্রেণি, বয়স ও পেশার মানুষ কেঁদেছে। গতকাল তো বটেই, গত কয়েক দিন ধরেই আলোচিত চরিত্র হয়ে উঠেছিল মাগুরার এ শিশুটি। দেশে নারী ও কন্যাশিশুর ওপর নিপীড়ন, ধর্ষণ ও নির্যাতন নিয়ে আলোচনা হয় প্রতিনিয়ত। ভুক্তভোগীর পরিবারগুলো এসব ঘটনায় বিষাদে নিমজ্জিত। মাগুরার নির্যাতিত শিশুটির ঘটনা সভ্যতার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। শিশুটি রেখে গেল অনেক প্রশ্ন। যেসব প্রশ্নের উত্তর দেশবাসী খুঁজছে বহুদিন ধরে।
বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে গত ৫ মার্চ মাগুরা শহরের নিজনান্দুয়ালী এলাকায় ধর্ষণের শিকার হয় কন্যাশিশুটি। প্রথমে মাগুরা সদর হাসপাতাল, এরপর অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়ে তাকে সিএমএইচের পেডিয়াট্রিক আইসিইউতে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তার শরীরে অসংখ্য নির্যাতনের ক্ষত ছিল। তার সুস্থতার জন্য মানুষ প্রার্থনা করে। শিশুটিকে সুস্থ করে তুলতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে চেষ্টা হয়েছে। চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা চেষ্টা করেছেন আপ্রাণ। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না। জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে থাকা শিশুটির জন্য গত কয়েক দিনে মানুষ পথে নেমেছে। ধর্ষকদের সর্বোচ্চ বিচারের দাবিতে মুখর হয় সারা দেশ। গত সোমবার জানা গিয়েছিল, শিশুটি চোখের পাতা নেড়েছে। এতে আশাবাদী হয়েছিল মানুষ। কিন্তু সব আশা বিফলে গেল।
গতকাল দুপুর ১টার পর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, ‘অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানানো যাচ্ছে যে, মাগুরায় নির্যাতিত শিশুটি আজ (গতকাল) ১৩ মার্চ ২০২৫ তারিখে দুপুর ১টায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) সর্বাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টাও তাকে বাঁচাতে পারেনি।’
আইএসপিআর জানায়, ‘শিশুটির আজ (গতকাল) সকালে তিনবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে, দুবার স্থিতিশীল করা গেলেও তৃতীয়বার আর হৃৎস্পন্দন ফেরেনি। উল্লেখ্য, গত ৮ মার্চ শিশুটিকে সংকটাপন্ন অবস্থায় ঢাকা সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শিশুটির শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছে এবং যেকোনো প্রয়োজনে তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শিশুটির বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছে।’ বিকেলে সামরিক হেলিকপ্টারে করে শিশুটির মরদেহ মাগুরায় তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়েছে।
শিশুটির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। শিশুটির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। আইন ও বিচার উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল দুপুরে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জানান, শিশু ধর্ষণের মামলাটির বিচার আগামী সাত দিনের মধ্যে শুরু হবে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, শিশু ধর্ষণের মামলার তদন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করা হবে।
মুমূর্ষু অবস্থায় গত ৭ মার্চ সন্ধ্যায় শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য শিশুটিকে গত শনিবার সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় শিশুটির মায়ের করা মামলার চার আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো শিশুটির বড় বোনের শশুর হিটু শেখ (৪৫), শাশুড়ি জাহিদা বেগম (৪০), বড় বোনের স্বামী সজীব শেখ (১৯) ও ভাশুর রাতুল শেখ (২৫)। আসামিরা বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পুরুষ তিন আসামির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
আসামিদের দ্রুত বিচারে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা : শিশুটির মৃত্যু সংবাদের পর গতকাল দুপুরে রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই শোকাহত। সেনাবাহিনীর চিকিৎসকদের প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি।’ তিনি বলেন, ‘অভিযুক্তদের দ্রুত আইনের আওতায় নিতে প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন। ধর্ষণ মামলাটির যেন দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
কয়েকটা নরপশুর নিষ্ঠুরতা কাঁদিয়েছে আমাদের মির্জা ফখরুল : বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শিশুটির বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোক জানিয়ে বলেন, ‘কয়েকটা নরপশুর নিষ্ঠুরতা তার মতো এক শিশুর মৃত্যুর কারণ। ক্ষতচিহ্ন নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় সংগ্রাম করে জগতের মায়া ছেড়ে আমাদের লজ্জা দিয়ে ও কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছে সে, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ নরপশুদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’
৯০ দিনের মধ্যে অপরাধীদের শাস্তি কার্যকর করার দাবি জামায়াতের আমিরের : ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত আসামিদের ৯০ কর্মদিবস নয়, সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে শাস্তি কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। গতকাল দুপুর সোয়া ২টার দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে এ দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘আসুন, মানুষ নামের এ পশুদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যক্তিগত এবং সামাজিকভাবে, সাংগঠনিকভাবে ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সোচ্চার হই। ধর্ষকদের ঘৃণা করি ও বয়কট করি।’ জামায়াতের আমির লেখেন, ‘বিধ্বস্ত পরিবারকে কোন ভাষায় সান্ত¡না দেব তা জানি না। ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। মহান আল্লাহ যেন তার পিতা-মাতাসহ আপনজনদের, বিবেকবান দেশবাসীকে শোক সহ্য করার তওফিক দান করেন।’
নির্যাতিতা শিশুর বোনের ভিডিও সরাতে নোটিস : মাগুরায় নির্যাতনের শিকার শিশুটির বোন, পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকারের সব ভিডিওর অপসারণ চেয়ে আইনি নোটিস পাঠানো হয়েছে। প্রচলিত আইন ও হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারের অভিযোগ করে গতকাল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. বাহাউদ্দিন আল ইমরান এ নোটিস পাঠান। তথ্য ও সম্প্রচার সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব; আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক সচিব, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান এবং পুলিশের মহাপরিদর্শকের উদ্দেশে এ নোটিস পাঠানো হয়। এতে নোটিসপ্রাপ্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়াসহ দেশের কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা চাওয়া হয়।