রমজান এসেছে বিপর্যস্ত গাজায়। যখন বিশ্বের অন্যান্য দেশ রোজা ও ইবাদতের এই মাসকে উৎসবের আমেজে গ্রহণ করেছে, তখন আমরা শোক ও দুঃখের মাঝে তা পালন করছি। যুদ্ধের প্রতিধ্বনি এখনো স্পষ্টভাবে শোনা যায়। এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। সামনে কী হতে যাচ্ছে, সেই বিষয়ে মানুষ উদ্বিগ্ন। সবাই এই ভেবে ভয় পাচ্ছে যে, যেকোনো সময় যুদ্ধ আবার শুরু হতে পারে। এই ভয়ের মধ্যেই গতকাল (১৮ মার্চ) ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় ভয়াবহ বিমান হামলা করেছে দখলদার সন্ত্রাসী বাহিনী ইসরায়েল। যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে চালানো এই হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা বেড়ে পৌঁছেছে কমপক্ষে ৩২৬ জনে। আহত হয়েছেন আরও বহু মানুষ।
এটি প্রথমবার নয় যে আমরা যুদ্ধের মধ্যে রমজান পালন করছি। ২০১৪ সালে আমি মাত্র নয় বছর বয়সী ছিলাম। কিন্তু আমি খুব ভালোভাবেই মনে করতে পারি, কীভাবে আমাদের রমজানের রাতগুলো বিমান হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞে ভরে উঠেছিল, কীভাবে আমাদের অন্ধকারের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল, যখন আমাদের আশপাশের এলাকাগুলো বোমার আঘাতে কেঁপে উঠছিল। কিন্তু গত বছরের রমজান ছিল আলাদা। এটি ছিল কল্পনাতীতভাবে আরও কঠিন। ক্ষুধার যন্ত্রণা সর্বদাই ছিল। আমরা সারাদিন রোজা রাখতাম। ইফতারে ছয়জনে ৩০০ গ্রাম বুট বা মটরশুঁটি ভাগ করে খেতাম। বিদ্যুৎ না থাকায় অন্ধকারে সেই নিরস খাবার চিবাতাম। টেবিলের ওপার থেকে পরস্পরের মুখও ঠিকমতো দেখতে পেতাম না।
আমরা অধিকাংশ আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে ছিলাম। আমার দাদি, খালা ও কাজিন, যাদের সঙ্গে আমি রমজান কাটাতাম, তারা সবাই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। কেউ তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছিল, কেউ আটকে ছিল গাজার উত্তরে। একসঙ্গে থাকার মাসটি পরিণত হয়েছিল বিচ্ছিন্নতা ও একাকিত্বের মাসে। গত বছর গাজায় রমজান তার চিরায়ত আনন্দময় চেতনা হারিয়ে ফেলেছিল। আমরা মাগরিবের সময় ইফতারের আগে কিংবা ফজরের সময় সাহরির আগে আজানের আওয়াজ শুনতে উদগ্রীব ছিলাম। কিন্তু সেই সুমধুর ধ্বনি শুনতে পারিনি। সব মসজিদ ধ্বংস করে ফেলেছিল। কেউ কেউ আজান দিতে চেয়েছিল। আবার ভয়ও পেয়েছিল। ভয় পেয়েছিল এই কারণে যে, তাদের কণ্ঠস্বর হয়তো বিমান হামলা ডেকে আনবে, তাদের টার্গেটে পরিণত করবে। বেশিরভাগ সময়ই আজান শোনার বদলে আমরা ইফতার করেছি ক্ষেপণাস্ত্র ও গুলির আওয়াজের মধ্য দিয়ে।
যুদ্ধের আগের বছরগুলোতে ইফতারের পর আমি পরিবারসহ মসজিদে যেতাম, নামাজ আদায় করতাম এবং আমাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা করতাম। এরপর আমরা গাজার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম, রমজানের উচ্ছল পরিবেশ উপভোগ করতাম। তারপর বাসায় ফিরে গরম গরম কাতায়েফ খেতাম। গত বছর পুরো গাজায় তারাবির নামাজ আদায় করার মতো কোনো জায়গা ছিল না।
গাজার অন্যতম সুন্দর ও ঐতিহাসিক গ্রেট ওমারি মসজিদ, যেখানে আমার বাবা ও ভাইয়েরা রমজানের শেষ দশ দিন ইতেকাফে কাটাতেন এবং কোরআনের সুমধুর তেলাওয়াত শুনতেন, সেটিও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। একসময় যে স্থানে শান্তি ও প্রার্থনার সুর বেজে উঠত, তা এখন ধুলোর স্তূপ ও ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে।
এ বছরের রমজান শুরু হয়েছে যুদ্ধবিরতির মধ্যে। ইফতারের সময় আর বোমার আঘাতে পৃথিবী কেঁপে উঠছে না। ফজরের নীরবতায় আর বিস্ফোরণের প্রতিধ্বনি নেই। ঘর সাজানোর, রঙিন বাতি ঝুলানোর ভয়ও নেই। ব্যথা ও ধ্বংসের মধ্যেও দীর্ঘ সময় স্থবির হয়ে থাকা জীবন গাজার রাস্তায় ফিরে আসার চেষ্টা করছে। যেসব দোকান ও বাজার এখনো ধ্বংস হয়নি, সেগুলো আবার খুলতে শুরু করেছে, ফেরিওয়ালারাও ফিরে এসেছে।
গাজার অন্যতম বড় একটি সুপার মার্কেট নুসাইরাত হাইপার মল, এটি পুনরায় চালু হয়েছে। রমজানের আগে আমার বাবা আমাকে এবং আমার বোনকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। উজ্জ্বল আলোকিত মলে ঢোকার পর আমরা উচ্ছ্বাস সামলাতে পারছিলাম না। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, যেন আমরা অতীতে ফিরে গেছি।
দোকানের তাকগুলো আবার পূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমাদের বহুদিনের আকাক্সিক্ষত খাবার, যেমন বিভিন্ন ধরনের চকলেট, বিস্কুট, চিপস, খেজুরের বাক্স, রঙিন শুকনো ফল ইত্যাদিতে ভরে গেছে। এই পণ্যগুলোর বেশিরভাগই বাণিজ্যিক ট্রাকের মাধ্যমে এসেছে। এগুলোর দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।
যুদ্ধে ৪৮ হাজারেরও বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন। তারা আর কখনো রমজান পালন করবেন না। অনেক ইফতার টেবিলে থাকবে ফাঁকা চেয়ার। একজন বাবা, যিনি আর কখনো তার সন্তানদের ডাকবেন না। একজন ভাই, যিনি আর রোজা ভাঙার জন্য অস্থির হবেন না। একজন মা, যিনি আর কখনো সুস্বাদু খাবার রান্না করবেন না। আমিও প্রিয়জনদের হারিয়েছি। ফলে উৎসবের আমেজ চলে গেছে, কিন্তু রমজানের মূল চেতনা এখনো বেঁচে আছে।
এই মাস হলো দুনিয়ার ব্যস্ততা থেকে সরে আসার এবং আমাদের বিশ্বাসের সঙ্গে পুনরায় সংযুক্ত হওয়ার মাস। এটি ক্ষমার মাস, আল্লাহর কাছে প্রার্থনার মাস এবং আত্মিক দৃঢ়তার মাস। আমাদের মসজিদগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে, কিন্তু আমাদের ইমান ভাঙতে পারেনি। আমরা এখনো ধ্বংসস্তূপের ঘর ও তাঁবুতে তারাবি আদায় করি, দোয়ায় আমাদের সব আশা প্রকাশ করি, কোরআন তেলাওয়াতে শান্তি খুঁজি, এই বিশ্বাস নিয়ে যে, আল্লাহ আমাদের সব কষ্টের প্রতিদান দেবেন। (ঈষৎ পরিমার্জিত)
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর আতিকুর রহমান