রোববার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

চিকিৎসকের ৭৫ শতাংশ পদ শূন্য

আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২৫, ০৮:০৪ এএম

দেশের ৪৩৫টি উপজেলা হাসপাতালের ৪৭ শতাংশ চিকিৎসকের পদ শূন্য। যে ৫৩ শতাংশ চিকিৎসক আছে, এর মধ্যে ২৮ শতাংশ চিকিৎসককে সংযুক্তি করা হয়েছে সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে। সে হিসেবে এই মুহূর্তে উপজেলা হাসপাতালগুলোর ৭৫ শতাংশ চিকিৎসকের পদই ফাঁকা। অর্থাৎ মাত্র ২৫ শতাংশ চিকিৎসক দিয়ে চলছে স্বাস্থ্যসেবার কাজ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ ১১ মার্চের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

এসব হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলেছেন, চিকিৎসকের অভাবে তৃণমূল মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। চিকিৎসা দিতে না পারায় এ মাসেও ঘোষণা দিয়ে জরুরি চিকিৎসাসেবা ও রোগী ভর্তি বন্ধ রাখা হয়েছিল দুটি হাসপাতালে। তবে উপজেলা হাসপাতালের এই চিত্র ‘পুরনো’ বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের পদায়নের চিত্র এ রকমই। এর মূল কারণ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা।

চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি পর্যবেক্ষণে আছে ও সংকট সমাধানে উদ্যোগ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয় এই চিত্র আমাদেরও পর্যবেক্ষণ। স্বাস্থ্য উপদেষ্টাও এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বসহকারে নিয়েছেন। চিকিৎসক সংকটের দুটি কারণ আছে। একটি হলো আগে উপজেলা থেকে অনেক ডাক্তার বড় বড় হাসপাতালে অ্যাটাচমেন্টে গেছে। দ্বিতীয় কারণ কনসালট্যান্টরা মেডিকেল কলেজ  বা নিকটবর্তী সদর হাসপাতালে চলে গেছে। এ ছাড়া সামগ্রিকভাবে চিকিৎসক সংকট রয়েছে। এগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ঘোষণা দিয়ে বন্ধ দুটি : গত এক মাসে পাবনার বেড়া ও বরগুনার বেতাগী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চিকিৎসক সংকটের কারণে ঘোষণা দিয়ে চিকিৎসাসেবা বন্ধ রেখেছিল। কমপ্লেক্স কর্র্তৃপক্ষ হাসপাতালের দেয়ালে ও গেটে ব্যানার টানিয়ে এই বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিল। পরে কিছু চিকিৎসক দেওয়ায় সেগুলোয় আবার সীমিত আকারে চিকিৎসাসেবা শুরু হয়েছে।

পাবনার বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মাত্র তিনজন ডাক্তার ছিল। এ মাসে তিনজন চিকিৎসক পেয়েছি। বর্তমানে ডিউটি করছেন ছয়জন। অথচ ৫০ শয্যার এই হাসপাতালে পদ অনুযায়ী ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা। এ রকম একটি হাসপাতালে কমপক্ষে চারজন হলেও কষ্ট করে চালানো যায়। কিন্তু তিনজন দিয়ে কিছুই হয় না। সেজন্য আমরা ঘোষণা দিয়ে সেবা বন্ধ রেখেছিলাম।’

বরগুনার বেতাগী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখানে চিকিৎসক শূন্য হয়ে গিয়েছিল। সেজন্য আমরা চিকিৎসা বন্ধের ব্যানার টানিয়েছিলাম। এর পর গত সপ্তাহে অধিদপ্তর থেকে পাঁচজন ডাক্তার দিয়েছে। কাজেই আপাতত ইমার্জেন্সি, ইনডোর ও আউটডোর চালানো যাচ্ছে। এটা ৫০ শয্যার হাসপাতাল। চিকিৎসকদের পদ ২০টি। অথচ আছে মাত্র পাঁচজন। উপজেলার দেড় লাখ মানুষের জন্য এ সংখ্যা কিছুই না।’

পদ ফাঁকা ৪৭ ও সংযুক্তি ২৭ শতাংশ : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১১ মার্চের হিসাব অনুযায়ী, দেশে মোট সরকারি চিকিৎসকের সংখ্যা ২৯ হাজার ১৮২ জন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ ৭ হাজার ৩১৭টি ও কর্মরত ৩ হাজার ৮৪৫ জন। অর্থাৎ মোট চিকিৎসকের মাত্র ১৩ শতাংশ উপজেলায় পদায়ন করা হয়েছে। অন্যদিকে, মোট পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত আছেন ৫৩ শতাংশ চিকিৎসক। বাকি ৪৭ শতাংশ পদে কোনো চিকিৎসক নেই। এমনকি যে ৫৩ শতাংশ পদে চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে ২ হাজারের বেশি, অর্থাৎ ৫২ শতাংশ চিকিৎসককে অন্য হাসপাতালে সংযুক্তি দিয়ে রেখেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

সর্বোচ্চ সাতক্ষীরায় ৭৩ ও সর্বনিম্ন ঢাকায় ১৬ শতাংশ : দেশে তিন ধরনের উপজেলা হাসপাতাল রয়েছে ৫০, ৩১ ও ২০ শয্যার। সরকারি অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী, ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা হাসপাতালের জন্য চিকিৎসকের পদ ২০-২১টি, ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে ৯টি ও ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে ৬টি।

এসব হাসপাতালের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সাত জেলায়। এসব জেলায় সর্বোচ্চ ৭৩ ও সর্বনিম্ন ৭০ শতাংশ চিকিৎসদের পদ ফাঁকা। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সাতক্ষীরা জেলার। এখানে উপজেলা হাসপাতাল ছয়টি। এর মধ্যে পাঁচটি ৫০ শয্যার। এখানে চিকিৎসক থাকার কথা ২০-২১ জন করে। কিন্তু আছে সর্বনিম্ন তিনজন ও সর্বোচ্চ পাঁচজন। এখানে ৭৩ শতাংশ পদ ফাঁকা। এরপর গোপালগঞ্জের চারটি উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ ৪০-৪৯টি। কিন্তু ৭২ শতাংশ পদেই কোনো চিকিৎসক নেই। এ ছাড়া বরগুনা ও বাগেরহাটের উপজেলা হাসপাতালগুলোয় ৭১ শতাংশ করে এবং কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ের হাসপাতালগুলোয় ৭০ শতাংশ করে পদে কোনো চিকিৎসক নেই।

চিকিৎসকের শূন্যপদ সবচেয়ে কম ঢাকা জেলার উপজেলা হাসপাতালগুলোয়, ১৬ শতাংশ। এরপর নারায়ণগঞ্জে ২০ শতাংশ, চট্টগ্রামে ২২, কুমিল্লায় ২৩, গাজীপুরে ২৫, মুন্সীগঞ্জে ২৭ এবং মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর ও চুয়াডাঙ্গায় ২৮ শতাংশ করে চিকিৎসকের পদ শূন্য।

২২ জেলায় ফাঁকা ৫০-৬৯ শতাংশ পদ : দেশের ২২ জেলার উপজেলা হাসপাতালগুলোয় গড়ে ৫০-৬৯ শতাংশ পদেই কোনো চিকিৎসক নেই। এর মধ্যে ভোলা ও পটুয়াখালী জেলায় চিকিৎসকদের শূন্য পদ ৬৯ শতাংশ করে, পিরোজপুরে ৬৭ শতাংশ, ঝিনাইদহ ও লালমনিরহাটে ৬৪ শতাংশ করে, ঝালকাঠি ও মেহেরপুরে ৬২ শতাংশ করে, বান্দরবান, জয়পুরহাট ও নওগাঁয় ৬০ শতাংশ করে, সুনামগঞ্জে ৫৮, রাজবাড়ী ও দিনাজপুরে ৫৭ শতাংশ করে, মাগুরায় ৫৬, গাইবান্ধায় ৫৫, জামালপুরে ৫৪, পাবনায় ৫৩, বরিশাল ও নীলফামারীতে ৫২ শতাংশ করে, রাঙ্গামাটি ও হবিগঞ্জে ৫১ শতাংশ করে, নেত্রকোনায় ৫০ শতাংশ পদ শূন্য।

বাতিল হচ্ছে আগের সংযুক্তি : উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসক সংকট কাটাতে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর। তিনি বলেন, ‘আগের সময়ে যেসব ডাক্তারের অ্যাটাচমেন্টে রাখা হয়েছে, তাদের অ্যাটাচমেন্ট ক্যানসেল করছি। যারা ট্রেনিংয়ে আছেন ও জরুরি সেবা দিচ্ছেন, তাদের সরাতে পারব না। চট্টগ্রামের এক দিনে ৩৯ জন ডাক্তারের অ্যাটাচমেন্ট ক্যানসেল করা হয়েছে। ঢাকাই চলছে। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও মানিকগঞ্জে শেষ হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৩টি ক্যানসেল করেছি। এদের মধ্যে দু-একজন যারা ট্রেনিংয়ে আছেন, তাদের আবার অ্যাটাচমেন্টে দিতে হচ্ছে। যদি দেখি কোনো বিভাগে ডাক্তার নেই, সেখানে অ্যাটাচমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। যেখানে বেশি জরুরি চিকিৎসা আছেন, সেখানে অ্যাটাচমেন্ট রাখতে হচ্ছে।’

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আরও ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ৪৫, ৪৬ ও ৪৭তম বিসিএসের মাধ্যমে সাড়ে ৩ হাজার ও বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে আরও ২ হাজার ডাক্তার নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে নেওয়ার জন্য ইতিমধ্যেই পিএসসিতে লিখেছে। স্বাস্থ্য উপদেষ্টার নির্দেশে আরও পাঁচ হাজার ডাক্তারের পদ তৈরির কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। তারপরও যেখানে চিকিৎসা জরুরি হয়ে পড়েছে, সেখানে আমরা ডাক্তার দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা কাটানোর পরামর্শ : অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘ব্যবস্থাপনাতেই সংকট। চিকিৎসক পোস্টিং দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক প্রশাসন। তার সঙ্গে সেবার কোনো সম্পর্ক নেই। উনি ওই হাসপাতালে সেবা সম্পর্কে কিছু জানেন না, দেখেনও না। ইউএইচএফপিওর ক্ষমতা খুবই সীমিত। উনি চাইলেও কোনো ডাক্তারকে উপজেলায় রাখতে পারেন না। নানা কারণে পদায়নের শুরুতেই চিকিৎসকরা চেষ্টা করেন উপজেলায় কম থাকতে। আমরা উপজেলায় অনেক চিকিৎসক দিয়েও দেখেছি কাজ হয় না। যদি ব্যবস্থাপনার এসব চরম দুর্বলতা কাটাতে না পারি, তাহলে চিকিৎসক সংকটের সমস্যাটা কমপক্ষে ৪০ বছর ধরেই আছে, আরও সামনের দিনে একই রকম থাকবে, হয়তো আরও অবনতি হবে।’

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, স্বাস্থ্য খাতের পদায়ন ব্যবস্থাটা অত্যন্ত জটিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সেখান থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সেখান থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়, এরপর চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে পিএসসি নিয়োগের উদ্যোগ নেয়। এভাবে দু-তিন বছর লেগে যায়। এভাবে চলতে থাকলে সব সময় চিকিৎসকের এই ঘাটতি থেকে যাবে, সমস্যার সমাধান হবে না। সেজন্য চিকিৎসকদের এভাবে পদায়ন না করে পদ খালি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন ওই পদের জন্য বিসিএস করা হয় এবং পদায়ন করা হয় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

সংযুক্তির পেছনে দুই ধরনের কারণ আছে জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘সদর হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসকের খুবই সংকট, মেডিকেল অফিসার মাত্র তিন-চারজন। অথচ সেখানে থাকার কথা ৫০-৬০ জন। সে কারণে সদর হাসপাতালে চাপ সামলাতে অনেক সময় উপজেলা থেকে চিকিৎসককে সংযুক্তি দেওয়া হয়। এ ছাড়া ডাক্তাররা এই সংযুক্তিতে থেকে আসলে ট্রেনিং করে। ট্রেনিং শেষ করে আর উপজেলায় ফিরে যান না। সেখান থেকেই বদলি হয়ে আরেক জায়গায় চলে যান। এ রকম এমডি এফসিপিএস এমএস করা বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে নানাভাবে আছেন। অথচ প্রয়োজন নেই, তাদের যদি আমরা ৬৪টি জেলা সদর হাসপাতালে দিতে পারি, তাহলে উপজেলা থেকে সংযুক্তি অনেক কমে যাবে।’

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত