যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প তার অভিবাসন নীতিকে আরও কঠোরভাবে কার্যকর করতে শুরু করেছেন। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশি অভিবাসীদের ওপর। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে এ পর্যন্ত কয়েক ধাপে ইতিমধ্যে ৩১ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাংলাদেশি ও দেশে ফেরত আসাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন এ অভিবাসন নীতির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যেসব বাংলাদেশির বৈধ কাগজপত্র নেই বা যাদের ভিসার মেয়াদ পেরিয়ে গেছে তারা কেউ কেউ এখন আত্মগোপনে চলে গেছেন। বাংলাদেশি মালিকানাধীন অনেক দোকান ও রেস্তোরাঁয় কর্মচারী সংকট দেখা দিয়েছে।
এ অবস্থায় আতঙ্ক ও আইনি জটিলতা এড়াতে এখনই প্রবাসীদের যথাযথ আইনগত প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ বহিষ্কারের হার অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে আরও কয়েকশ বাংলাদেশিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হতে পারে। অবশ্য এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপের প্রশংসা করেন তারা। প্রবাসফেরতদের মানবিক ও সম্মানজনকভাবে গ্রহণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সমন্বিত পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে জানান পর্যবেক্ষকরা।
ফেরত পাঠানো হয়েছে ৩১ বাংলাদেশিকে : নতুন নীতিমালার আওতায় চলতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশি নাগরিকদের ফেরত পাঠাতে শুরু করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ৩১ জন বাংলাদেশিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩০ জন পুরুষ এবং একজন নারী। তারা কেউ কেউ অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন, আবার কেউ কেউ মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন। বেশিরভাগকে নিয়মিত বাণিজ্যিক বা ভাড়া করা বিশেষ চার্টার্ড ফ্লাইটের মাধ্যমে দেশে পাঠানো হয়েছে। আর তিনজনকে বিশেষ নিরাপত্তায় মার্কিন কর্মকর্তারা সরাসরি ঢাকায় পৌঁছে দিয়েছেন। গত শনিবার একটি বিশেষ চার্টার্ড ফ্লাইটে পাঁচজন বাংলাদেশিকে ঢাকায় ফেরত আনা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব ফেরত পাঠানোর আগে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে তালিকা পাঠিয়ে অনুমতি নেয়। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ‘আইস’ ইতিমধ্যে বৈধ কাগজপত্রহীন ৪০০ থেকে ৫০০ বাংলাদেশিকে আটক ও ফেরত পাঠানোর জন্য শনাক্ত করেছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে সীমিতসংখ্যক বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো শুরু করেছে।
এদিকে অভিবাসন নীতি ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রে ধরপাকড় শুরু হয় এবং কয়েকটি দেশের নাগরিককে হাতকড়া ও টেনেহিঁচড়ে আটক করে দেশে ফেরত পাঠানোর ঘটনায় বাংলাদেশিদের মধ্যে আরও উদ্বেগ বেড়ে যায়। এ পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে অনুরোধও জানানো হয়। গত ফেব্রুয়ারিতেই এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়। ফেরত আসাদের বিমানবন্দরে গ্রহণ করার পর যার যার বাড়িতে ফেরার জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরুর) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম আরিফা সিদ্দিকী বলেন, ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির কারণে বাংলাদেশ তো অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে সেখানে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীরা বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে। তিনি বলেন, অনেকে আছে যাদের কাগজপত্রে খুব বড় ধরনের ঝামেলা নেই। তারা যদি আইনজীবীদের কাছে যায় তাহলে ফেরত এড়ানো সম্ভব।
বাংলাদেশিদের আতঙ্ক : ‘আপাতত আত্মগোপনে’
নিউ ইয়র্ক ও লস অ্যাঞ্জেলেসে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা বলছেন, নতুন এ অভিবাসন নীতির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যেসব বাংলাদেশির বৈধ কাগজপত্র নেই বা যাদের ভিসার মেয়াদ পেরিয়ে গেছে তারা কেউ কেউ এখন আত্মগোপনে চলে গেছেন। বাংলাদেশি মালিকানাধীন অনেক দোকান ও রেস্তোরাঁয় কর্মচারী সংকট দেখা দিয়েছে।
নিউ ইয়র্কে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন নজির আহমেদ এই প্রতিবেদককে বলেন, বাংলাদেশ থেকে আসা অনেকেই যাদের এখনো কাগজপত্র হয়নি তারা আমাদের মালিকাধীন রেস্তোরাঁয় কাজ করেন। কিন্তু নতুন অভিবাসন নীতি ঘোষণার পর তারা আর কাজে আসছেন না। তিনি বলেন, ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস) কর্র্তৃপক্ষ যেকোনো সময় হানা দিতে পারে এ আশঙ্কায় তারা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোতেও ভয় পাচ্ছেন। কেউ কেউ ইমিগ্রেশন আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন; কেউ আবার দেশেও ফেরার পরিকল্পনা করছেন।
কী আছে ট্রাম্পের নীতিতে?
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে অভিবাসন নীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসরত অভিবাসীদের দ্রুত শনাক্ত করে তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো। তিনি একে ‘যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বহিষ্কার অভিযান’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এর আওতায় শুধু বাংলাদেশি নয়, অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশ থেকেও নাগরিকদের ফেরত পাঠানো শুরু হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার আরও জানিয়েছে, কাগজপত্রবিহীন অভিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে একযোগে অভিযান চালানো হবে। ট্রাম্প প্রশাসন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পরিধিও সম্প্রসারণের চিন্তা করছে।
ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে?
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক সিটি ও ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস সিটিতে বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ দুটি সিটির বাংলাদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে রেস্টুরেন্ট, গ্রোসারিতে কর্মরত কাগজপত্রবিহীন বাংলাদেশিশূন্য হয়ে পড়েছে। কারণ অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। শুধু বাংলাদেশি অভিবাসী নন, যারাই কাগজপত্রবিহীন, তারাই একই পথ অবলম্বন করেছে। ‘আইস’ এজেন্টরা যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে সন্দেহভাজন অবৈধ অভিবাসীর খোঁজে হানা দিচ্ছেন। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে পর্যন্ত তল্লাশি চালাচ্ছেন।
অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কার ঠেকানোর আশ্বাস দিয়ে বিভিন্ন কমিউনিটির ইমিগ্রেশন আইনজীবীরা তৎপর হয়ে উঠেছেন। যারা ইমিগ্রেশন আইনজীবীদের সহায়তা নেবেন, তারা তাদের কাগজপত্র যদি যথানিয়মে সংশ্লিষ্ট ইমিগ্রেশন কর্র্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছাতে পারেন, তাহলে সাময়িকভাবে বহিষ্কার ঠেকানো সম্ভব হলেও কজন অভিবাসীর পক্ষে ইমিগ্রেশন আইনজীবীদের উচ্চ ফি পরিশোধ করা সম্ভব, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। অবৈধ অভিবাসীদের আইনি সহায়তায় আর্থিকভাবে সহযোগিতা করার জন্য বাংলাদেশি কমিউনিটিতে কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও নেই।
যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশি অভিবাসীর মোট সংখ্যা সম্পর্কে ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অথবা বাংলাদেশি কমিউনিটি সংগঠনগুলোর কাছে কোনো পরিসংখ্যান নেই। ‘আইস’ এজেন্টরা এখন অবৈধ অভিবাসীদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। তারা যে শুধু অবৈধ অভিবাসীদের আটক করে ফেরত পাঠাচ্ছে তাই নয়, বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে এসে যারা যথাসময়ে ফেরত যাননি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করার জন্য প্রয়োজনীয় ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া শেষ না করেই যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন, এমনকি স্টুডেন্ট ভিসায় যারা যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে এসে আর্থিক কারণে ছাত্রত্ব বজায় রাখতে অসমর্থ হয়ে পরবর্তীকালে বিনা ওয়ার্ক পারমিটে কাজকর্ম শুরু করেছেন, তারাও অবৈধ অভিবাসীর মধ্যে গণ্য হবেন। গ্রিনকার্ডধারী বা যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমোদনপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও বহিষ্কৃত হবেন এবং ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রকে আটক করে তাদের নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বেশ কিছু আটক ছাত্রকে বহিষ্কারের প্রক্রিয়া চলছে।