গণঅভ্যুত্থানের পর দেশ পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে পুলিশ। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি করতে পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও ভালোভাবে অনুষ্ঠিত করতে পুলিশ নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে। স্বাধীন কমিশন গঠন করলে পুলিশও স্বাধীন হবে। কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতারা পুলিশের ওপর কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না। পুলিশ দিনরাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে। সংসার কী জিনিস তা ভুলে যায় পুলিশ।
গতকাল মঙ্গলবার রাজারবাগ পুলিশ লাইনস অডিটরিয়ামে পুলিশ সপ্তাহ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। অনুুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলমসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
নাম প্রকাশ না করে পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এই প্রথম পুলিশ সপ্তাহে খোলামেলা কথা বলেছেন পুলিশের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অন্য সদস্যরা। প্রধান উপদেষ্টার সামনেও একজন কনস্টেবল ও এএসপি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা খোলামেলা কথা বলেন। তারা পুলিশের বাস্তব বিষয় নিয়ে কথা বলেন। অথচ অন্যান্য বছর পুলিশ সপ্তাহে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের খুশি করতে কথা বলতেন অনেকেই। ওই সময় ৫ মিনিটের বক্তব্য শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশংসা করে অন্তত ৪ মিনিটই কথা হতো। এবার কিন্তু তা হয়নি।
পুলিশ সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে পুলিশের দুই সদস্য বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে বক্তব্য রাখেন। পুলিশ সদর দপ্তরের এএসপি আল আসাদ তার বক্তব্য বলেছেন, গত ১৬টি বছর আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশকে ব্যবহার করেছে। তারা পুলিশের কাঁধে বন্দুক রেখে দেশ শাসন করেছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশের বড় কর্তারা পালিয়ে গেছেন। কেউ দেশে আছেন আবার কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছেন। এসব কর্তা নিজেদের মতো পুলিশ চালিয়ছেন। তাদের পছন্দের লোকদের পদোন্নতি ও ভালো স্থানে পদায়ন করেছেন। যারা নিরীহ ও ভালো অফিসার ছিলেন তারা অবহেলিত ছিলেন। এখন সময় এসেছে, স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার। এজন্য স্বাধীন কমিশন দ্রুত গঠন করতে হবে। এই কমিশন গঠন করলে রাজনৈতিক নেতারা পুলিশকে তাদের কাজে ব্যবহার করতে পারবে না। তার বক্তব্যের সময় উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তারা হাততালি দিয়ে সাধুবাদ জানান।
ঢাকা জেলার কনস্টেবল সামিয়া স্বর্ণা তার বক্তৃতায় বলেন, ‘পুলিশ দিনরাত ২৪ ঘণ্টায় কাজ করে। কখনো সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ডিউটি করতে পারে না। সংসার কী জিনিস তা অনেক পুলিশ ভুলেই যান। সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বছরে ১২৯ দিন ছুটি পেয়ে থাকেন। আমরা ঠিকভাবে ছুটি পাই না। পুলিশের পক্ষ থেকে আমি চাচ্ছি বছরে একবার বেসিক স্যালারি দিলে আমরা পুষিয়ে নিতে পারব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাই। এই সমাজে পুলিশ ছাড়া কিছুতেই চলবে না। সব পুলিশ খারাপ না। তবে আমাদের খারাপ তৈরি করেন রাজনৈতিক নেতারা। এসব হস্তক্ষেপ থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই।’
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষ হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। সেখানেও পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত বক্তব্য রাখেন। সবাই ট্রাফিকদের দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাসহ ট্রাফিক বক্স, শেল্টার স্থাপন, রাতে টহলরত পুলিশ সদস্যদের জন্য তাঁবু স্থাপন, মাদকের মূল হোতাদের ধরতে শক্ত অভিযান পরিচালনা ইত্যাদি বিষয়েও আলোচনা হয়। এ বৈঠকেও পুলিশ যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেজন্য পরিবেশ তৈরি করার দাবি তোলা হয়। ওইদিন বেলা ৩টায় পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা অনির্ধারিত একটি বৈঠকে মিলিত হন। সেখানে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন। বিদেশ থেকে কোনো ধরনের চাপ এলেও পুলিশ মাথানত করবে না। বুক ফুলিয়ে থাকবে।
বৈঠক সূত্র জানায়, একটি বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, জনবান্ধব পুলিশ হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। অপ্রয়োজনে লাঠিচার্জ বা বলপ্রয়োগ করা যাবে না। পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারও কাছ থেকে কোনো বিশেষ সুবিধা নেওয়া যাবে না। ঘুষ, দুর্নীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে হবে। কাজ করতে গিয়ে পুলিশ সদস্যদের অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যে বিষয়টি সর্বাগ্রে প্রয়োজন তা হচ্ছে পুলিশ সদস্যদের ধৈর্যধারণ। ধৈর্যধারণ করে আলোচনার মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। পুলিশ সদস্যদের ব্যবহার, সেবার মানসিকতা ও আন্তরিকতা দিয়ে মানুষের মন জয় করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে পুলিশের প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। সাধারণ মানুষ যেন কোনোরকম হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। পুলিশে সবচেয়ে প্রকট সমস্যা অধস্তন ফোর্সদের থাকা ও খাওয়ার সমস্যার কথা উল্লেখ করে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, পুলিশের যানবাহন সমস্যা রয়েছে। তবে তা সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। থানার জন্য ২০০টি পিকআপ ভ্যান কেনার প্রক্রিয়া চলছে। সমস্যা সমাধানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কাজ করা হচ্ছে। পুলিশের নানা কল্যাণমুখী কার্যক্রম তুলে ধরে তিনি বলেন, পুলিশের সুদূরপ্রসারী কল্যাণে বর্তমান সরকার কাজ করছে। কনস্টেবল থেকে এসআইদের ঝুঁকিভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে উচ্চ সীমা (সিলিং) বন্ধ করার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে নিচের স্তরের পুলিশ কর্মকর্তারা আগের চেয়ে অধিক হারে ঝুঁকিভাতা পাবেন। পুলিশ সদস্যদের মোটরসাইকেল কেনার জন্য ঋণ প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে পুলিশের এসআই ও এএসআইদের এ ঋণ দেওয়া হবে। সরকার যাতে ঋণের সুদের টাকা পরিশোধ করে সে বিষয়েও অনুরোধ জানানো হবে। অধস্তন পুলিশ সদস্যদের নিজেদের বৃহত্তর জেলার মধ্যে পদায়নের চিন্তাভাবনা করছে সরকার। একইভাবে স্বামী-স্ত্রী দুজনে পুলিশ সদস্য হলে তাদের একই জেলায় পদায়নে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। পুলিশের জনবল সংকটের কথা উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে (টিওএন্ডই) জনবল বৃদ্ধি করা দরকার। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে তিনি আইজিপিকে নির্দেশ দেন।
বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী উপস্থিত ছিলেন। মতবিনিময় সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন আইজিপি বাহারুল আলম।