
বাংলাদেশের আদি-ইতিহাস চর্চা ও গবেষণায় নানা অসংগতি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে উজ্জ্বল অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বিশেষত প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসচর্চায় পথিকৃৎ হয়ে আছেন আহমদ হাসান দানি, আব্দুল করিম, আব্দুর রহিম, এবিএম হবিবুল্লাহ, মমতাজুর রহমান তরফদার, ইয়াকুব আলী, আব্দুল মমিন চৌধুরী প্রমুখ যারা মুদ্রা, শিলালিপি কিংবা স্থাপত্যের মতো প্রাথমিক উৎস-নির্ভর গবেষণা করে আমাদের জন্য রেখে গেছেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বর্তমান সময়েও সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, এ কে এম শাহনাওয়াজ, এমরান জাহান, পারভীন হাসান, শাহনাজ হোসনে জাহান, মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ প্রত্নতাত্ত্বিক-ঐতিহাসিক প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসচর্চায় অবদান রেখে চলেছেন। এ বছর বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান নামে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির যে গ্রন্থ রচনা করেছে তা আমাদের উপরোক্ত পথিকৃৎ ঐতিহাসিকদের যে গবেষণা, উদ্ভাবন ও ব্যাখ্যা তাকে ধারণ করে না। বিষয়টি এমনও নয় যে লেখকরা নিজেরাই সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক সময়ের গবেষক এবং তারা নিজেরাই গবেষণা করে সে তথ্যসমূহ বের করেছেন।
‘বখতিয়ার খলজি অনেক বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংস করেছেন’ এরকম অনেক অনৈতিহাসিক, অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েই লিখা হয়েছে এবারের স্কুলের পাঠ্যবই। কোনো নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সোর্সই এ ধরনের বক্তব্যের সত্যতা প্রতিপাদন করে না। মনে হয়েছে, ইতিহাস নয় বরং লেখকদের কারও কারও নিজস্ব বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে বইয়ের পাতায় পাতায়। পাক-ভারত-বাংলাদেশ এক সময়ে ছিল বৌদ্ধ অধ্যুষিত। সেই বৌদ্ধরা কীভাবে এদেশ থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়ে গেল তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, তবে তার কোনোটাতেই বখতিয়ার খলজিকে অনেকগুলো বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংসের জন্য দায়ী করা হয়নি। কয়েকজন নালন্দা/বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়/কিংবা ওদন্তপুরী ধ্বংসের জন্য বখতিয়ার খলজিকে দায়ী করলেও সেটাকে আবার অধিকাংশ ঐতিহাসিক নাকচ করে দিয়েছেন। কারণ, তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগগুলোর পেছনে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ নেই, বরং বিদ্বেষপ্রসূত মনোভাবকেই দায়ী বলে গবেষকরা মনে করেন।
রাধাকৃষ্ণ চৌধুরী ১৯৬০-৭২ সাল পর্যন্ত পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ওপর ভিত্তি করে ‘Decline of the University of Vikramasila’ প্রবন্ধ লিখে পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছেন যে বখতিয়ার খলজির বাংলা অভিযানের সঙ্গে বিহার ধ্বংসের কোনো সম্পর্কই ছিল না। রাধাকৃষ্ণ চৌধুরী লিপিতাত্ত্বিক (Epigraphic) ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছেন যে, নালন্দা/বিক্রমশীলা ধ্বংসের সঙ্গে বিজয় সেনের যুক্ততা ছিল, যিনি সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা হেমন্ত সেনের ছেলে। তাদের বসবাস ছিল বর্তমান রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার দেওপাড়া। দেওপাড়াতে প্রাপ্ত একটি লিপিসাক্ষ্যের ভিত্তিতে তিনি এরূপ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ বিষয়গুলো অনেক জটিল, এবং পুরো রহস্য অনুদঘাটিত। তদুপরি এগুলোর আধুনিক বয়ানের সঙ্গে আছে উপমহাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির নানা জটিল হিসাব-নিকাশ। এরকম বিষয়সমূহ উচ্চতর অধ্যয়নের জন্য বিবেচনা করা উচিত, স্কুলের শিশু-কিশোরদের জন্য তা মোটেও উপযুক্ত নয়।
বইটিতে আরও অনেক অসংগতি রয়েছে। বিশেষ করে বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাসকে অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনে নানা চাতুর্যের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে যা সম্পূর্ণভাবে অনৈতিহাসিক এবং প্রপাগা-ামূলক। যেমন মুসলিম শাসকদের ‘বহিরাগত’ এবং ‘দখলদার’ এবং আক্রমণকারী ও বর্বর হিসেবে যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে তা ইতিহাসের গবেষণায় অপ্রমাণিত। কে বহিরাগত আর কে ভূমিপূত্র? এই আলাপ তুলে কাউকে শ্রেষ্ঠ আর কাউকে হেয় করা এক ধরনের অপরাধের শামিল। এই ধরনের আলাপ যে আমাদের করতে হচ্ছে এটাও একটা দুর্ভাগ্য। কারণ আপনি যখন একটি জনগোষ্ঠীকে ‘দখলদার’ এবং ‘আক্রমণকারী’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবেন ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে সেটা অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে।
একটু পেছন থেকে ঘুরে আসা যাক। পৃথিবীতে আধুনিক মানুষের ইতিহাস হলো অভিবাসনের। পৃথিবীর সব প্রি-হিস্টোরিয়ান একমত যে, আধুনিক মানুষের উদ্ভব ঘটেছিল আফ্রিকায় এবং তারপর তারা ধীরে ধীরে পৃথিবীর নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। এই যে ছড়িয়ে পড়া সেটা ঘটেছে একাধিক সময়ে। এই সময়গুলোকে গবেষকরা আবার নানাভাবে ভাগ করেছেন বোঝার সুবিধার জন্য। আজকের যে পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশ, এখানেও একসময় কোনো মানুষ ছিল না। এখানকার সব মানুষই, সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষই বাইরে থেকে এসেছে। সে হিসেবে সবাই বহিরাগত। পার্থক্য শুধু সময়ের। কেউ আগে কেউ পরে এসেছে। এই ধারাটি চলমান ছিল আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত।
আদিম মানুষের এই অভিবাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কে বলা হয় নবপলীয় যুগ (Neolithic)। এই সময়কে ডিফাইন করা হয় কৃষিকাজের শুরু, স্থায়ী বসতি ও পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে উন্নত ব্যবহার্য হাতিয়ার (Tools) শনাক্তকরণের মাধ্যমে। এই যে নবপলীয় সময় সেটাও আবার সবখানে একইসঙ্গে আসেনি। একেক স্থানে একেক সময়। যেমন, বাংলার ক্ষেত্রে সময় এখনো সঠিকভাবে জানা যায় না।
উপমহাদেশে নবপলীয় সময়ের অনেক আগে থেকেই মানুষের বসতি ছিল। বিশেষত বর্তমান বাংলাদেশ অংশসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে, ধারণা করা হয়, প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে আধুনিক মানুষের আগমন ঘটেছিল। আর্য নামে যে জনগোষ্ঠী এই উপমহাদেশে বসতি গড়ে তুলেছিল সেটাও ছিল নবপলীয় যুগের পরের অথবা কাছাকাছি সময়ে। এরাও এসেছিল বর্তমান ইরান-আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার কিছু এলাকা থেকে। বর্তমানে দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় নামে যে জনগোষ্ঠী তারাও এসেছিল বর্তমানের পাকিস্তান ও ইরান সীমান্তবর্তী কোনো এক এলাকা থেকে। তারও আগে আরেকটি ইন্দো-ইরানি জাতিগোষ্ঠী বসতি গড়ে তুলেছিল বর্তমান পাকিস্তানের মেহেরগড় এলাকায়, এরাই মূলত পরবর্তীকালে সিন্ধু/হরপ্পা সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। এই ইন্দো-ইরানিরা আবার এসেছিল বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য থেকে। আদতে বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য কেবল ভারতই নয় আধুনিক ইউরোপিয়ানদেরও পূর্বভিটা। এই ধারা চলমান ছিল গ্রিক, গ্রেকো-ব্যাকট্রিয়ান, তুর্ক, আফগান, মুঘল প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী পর্যন্ত। আর্য, দ্রাবিড়, তুর্ক, আফগান, মুঘলরা তথাকথিত ‘বহিরাগত’ হলেও তারা আর ফিরে যায়নি, এই ভূমিকেই তারা নিজেদের করে নিয়েছিল। এগুলো সবই ছিল উল্লেখযোগ্য বড় আকারের আগমন, যারা স্থানীয় রাজনীতিতেও অংশ নিয়েছিল। এর বাইরেও আপনি দেখবেন, বিশেষত উত্তরের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে চাইনিজ বংশোদ্ভূত মানুষ, যারা এসেছিল পূর্ব দিক থেকে অর্থাৎ চায়না ও সংলগ্ন এলাকাগুলো থেকে। যতদূর জানা যায়, মুন্ডা, সাঁওতাল, খাসিয়া, খুমিকসহ অস্ট্রো-এশিয়াটিক জাতিগোষ্ঠীসমূহ আফ্রিকা থেকে সুদূর অতীতের কোনো একসময়ে এ উপমহাদেশে সবার আগে এসে পৌঁছেছিল। এ উপমহাদেশের আদি অধিবাসী যদি কাউকে বলতে হয় তবে এদেরই বলতে হবে।
আবার বর্তমান বাংলাদেশ এক সময় ছিল সমুদ্রবক্ষে, যা লাখ লাখ (প্রায় ১২৪ মিলিয়ন) বছরে পলিমাটি দিয়ে ভরাট হয়ে এর ভূ-ভাগ গঠিত হয়েছে। এই ভূ-ভাগ গঠন প্রক্রিয়া এখনো চলমান। এখানেও পূর্ব ও পশ্চিম থেকে মানুষ এসেছে, তবে আর্যরা বাংলায় আসার আগেই এখানে নানা মানবগোষ্ঠী ছিল যাদের মধ্যে, খুব সম্ভবত, অগ্রবর্তী ছিল মুন্ডা, সাঁওতাল, খাসিয়া, জৈন্তিয়া, কোডা প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী। অর্থাৎ এই উপমহাদেশ হলো এমন একটি এলাকা যেখানে পশ্চিম (মধ্যপ্রাচ্য-ইরান-আফগান-মধ্যএশিয়া) ও পূর্ব (চায়না-দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) থেকে মানুষ প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে প্রাক-আধুনিক সময় পর্যন্ত অভিবাসিত হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ স্থায়ীভাবে থেকে গেছে, কেউ আবার চলে গেছে, কেউ কেউ লুটপাট করে নিয়ে গেছে অর্থ-সম্পদ।
তাহলে স্থানীয় আর বহিরাগত কে? আর্যরা ভারতে এসে এই ‘স্থানীয়’ বা পূর্বে আগত অধিবাসী বা অনার্যদের ওপর নিপীড়ন করেছে, যেহেতু তারা সাংস্কৃতিকভাবে শক্তিশালী ছিল। একই কারণে অন্য জাতিগোষ্ঠী কিংবা ধর্মীয়-গোষ্ঠীগুলোর ওপরে নানাভাবে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেছে এবং এখনো করছে। এদের নিপীড়নেই ‘স্থানীয়’ অনার্যরা যখন যেখানে আশ্রয় পেয়েছে তাকেই গ্রহণ করেছে। কখনো বৌদ্ধ কিংবা কখনো ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় খুঁজেছে।
এই আর্যরা নিজেদের ভূমিপূত্র বলে দাবি করে এবং ‘বহিরাগত’ ও ‘আক্রমণকারী’ তত্ত্ব হাজির করেছে। এরা নিজেরাই ‘বহিরাগত’ ও ‘আক্রমণকারী’ হওয়া সত্ত্বেও অন্যদের এইভাবে ট্যাগিং করছে কেবল নিজেদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বজায় রাখার জন্য। এই উপমহাদেশীয় যে সভ্যতা সেই সভ্যতা বিনির্মাণে এখানে আগত সব জাতিগোষ্ঠীরই অবদান রয়েছে। তথাপি কেবল ক্ষমতার জন্য তারা বিভক্তি-রেখা জিইয়ে রাখছে যা আধুনিক ভারতে রাজনীতির মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করলেও বাংলাদেশে ছিল না।
এখন এই বিভক্তি-রেখা কেবল ভারতে নেই, এই বছর পাঠ্যপুস্তকের ওপরে ভর করে বাংলাদেশেও এই ঘৃণ্য চর্চা শুরু হয়ে গেল। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা কেউ বলতে পারে না। তবে এটা যে অশুভ শক্তির কাজ সেটা কি অস্বীকার করা যাবে? এটা হতে পারে অবচেতন মনে ঘৃণার বীজ বহন করা কেউ এদেশের কোমলমতি শিশু-কিশোরদের গ্রন্থ রচনার দায়িত্ব পেয়ে গিয়েছে। আশা করি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্র্তৃপক্ষ এই অশুভ শক্তিকে চিহ্নিত করবেন এবং এ বিষয়ে সজাগ হবেন। বইটিতে ব্রিটিশ শাসন এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে মহিমান্বিত করা হয়েছে! ইংরেজ ও জমিদারদের নানা অত্যাচার ও নিপীড়নকে কৌশলে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তিতুমীর, ফরায়েজী আন্দোলন, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ইতিহাস সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাদের পূর্বপুরুষরা যে ব্রিটিশ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন তা ভুলিয়ে দেওয়ার প্রায় সব আয়োজনই সম্পন্ন করা হয়েছে।
মোটাদাগে বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রত্নস্থান ও ঐতিহাসিক নিদর্শন বইতে খুবই কম গুরুত্ব পেয়েছে। বইতে উয়ারী-বটেশ্বর ও পাহাড়পুর, ময়নামতি নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অনুচ্ছেদই নেই! ময়নামতি, কান্তজীর মন্দির, পুঠিয়া মন্দিরসহ বাংলাদেশের বিহার, মন্দির ও মসজিদ সম্পর্কেও তেমন বর্ণনা দেওয়া হয়নি। যদিও কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে ভারতের অনেক মন্দির ও বিহারের ছবি ও লেখা স্থান পেয়েছে। ভারতে কিভাবে আদি-মানবের অভিবাসন হয়েছে সেটা নিয়ে নাতিদীর্ঘ ক্লান্তিকর বর্ণনা থাকলেও বাংলাদেশের প্রাগিতিহাসের আলোচনা অসম্পূর্ণ। অথচ অধ্যাপক দিলীপ কুমার চক্রবর্তী, অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ কামরুল আহসান, অধ্যাপক মোজাম্মেল হক ও অধ্যাপক জয়ন্ত সিংহ রায় এ বিষয়ে খুবই মৌলিক গবেষণা করেছেন যা দেশে ও বিদেশের গবেষণা সাময়িকীতে ছাপা হয়েছে। এ বইটি বাংলাদেশের নামে হলেও কোনোভাবেই বাংলাদেশের আদি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে না। বইটি বাতিল করা হোক এবং দেশের প্রথিতযশা ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের আদি ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ রচনার উদ্যোগ নেওয়া হোক।
লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত।
‘পুলিশ’ শব্দটা শুনলেই অনেকের মনে আতঙ্ক কিংবা ভয়ের উদ্রেক হয়। কেউ বা আবার ঘৃণা বা বিরক্তিতে মুখ বেঁকিয়ে ফেলেন। ওই কেউ কেউই আবার তাদের আপনজনের পুলিশের চাকরি পাওয়াতে ভীষণ আনন্দিত হন। এই দ্বৈত অনুভূতি নিয়েই আমাদের সাধারণের দৃষ্টি পুলিশ এবং পুলিশি ব্যবস্থার দিকে। ভারতীয় উপমহাদেশে পুলিশি ব্যবস্থার প্রচলন সুপ্রাচীনকাল থেকেই। এমনকি পুরাণ ঘেঁটেও পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনকারী সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব। মধ্যযুগে মুঘল সাম্রাজ্যের সময় থেকেই একদল ব্যক্তি পুলিশের মতো দায়িত্ব পালন করতেন কিন্তু আধুনিক পুলিশি ব্যবস্থাপনার উদ্ভব ভারতীয় উপমহাদেশে ঘটে ব্রিটিশ আমলে। মূলত সিপাহি বিদ্রোহের পর এ বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের আগ্রহ বাড়ে এবং লর্ড ক্যানিংয়ের নেতৃত্বে ১৮৬১ সালে সংসদে এই ব্যবস্থা গৃহীত হয়। পুলিশের কার্যক্রম ও কর্মপরিধি অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট। কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের নিরাপত্তা বিধান এবং প্রশাসনিক সুনির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব পালন করাই পুলিশের প্রধান কাজ।
বাংলাদেশে পুলিশি সংস্থার সূচনা হয় ভারত বিভক্তির পরপরই। প্রাথমিকভাবে নামকরণ হয় ‘ইস্ট বেঙ্গল পুলিশ’, পরে নাম বদলে রাখা হয় ‘ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ’, যা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ববঙ্গের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে পুলিশ দায়িত্ব পালন করে এবং অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ও কর্মচারী জীবন উৎসর্গ করেন। বিজয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশে পুলিশের নাম হয় ‘বাংলাদেশ পুলিশ’। জনগণের সেবায় সরকারি চাকরি হিসেবে ভীষণ জনপ্রিয়তা পায় এই পেশাটি। কিন্তু সব পেশার মতোই এই পেশাতেও কিছু নীতিহীন, দুর্নীতি মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তির অনুপ্রবেশ পেশাটিকে কলঙ্কিত করেছে অনেক সময়। পুলিশি ব্যবস্থার সূচনায় যেমন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দমনের প্রয়াস ছিল, সেই মনোভাব রয়ে যাওয়ায় অনেক সময় সরকারি দলের পক্ষে অবস্থান করার অভিযোগেও পুলিশি প্রশাসন দায়বদ্ধ হয়।
কথায় আছে, ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’, যার সহজ মানে হলো পুলিশ বাঘের থেকেও ভয়ংকর। প্রবাদ হিসেবে এই কথাকে অস্বীকার করার সুযোগ না থাকলেও আমরা একটু ভিন্ন চোখেও তাকাতে পারি বাংলাদেশ পুলিশের দিকে। উত্থাপিত অভিযোগগুলোকে অস্বীকার না করেই আমরা একটু ভিন্নভাবে দেখতে পারি বাংলাদেশ পুলিশ ও পুলিশি প্রশাসনের দিকে। বর্তমানে লক্ষাধিক মানুষ বাংলাদেশ পুলিশে নিয়োজিত রয়েছে। তারা কোনো না কোনোভাবে আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা জানাশোনা। তাদের রয়েছে পরিবার ও আপনজন। কিন্তু সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা তাদের ভিনগ্রহের মানুষের মতো বিবেচনা করি এবং সেই বিবেচনার বেশির ভাগটাই নেতিবাচক।
অন্যান্য পেশার থেকে পুলিশের সাধারণ সদস্যদের কর্মঘণ্টা বেশি, দায় ও দায়িত্ব বেশি এবং তাদের ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা কম। ট্রাফিক পুলিশের কথাই ভাবুন না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তারা রাস্তায় রাস্তায় ডিউটি করে। রোদ, বৃষ্টি, গরম সবকিছুকে উপেক্ষা করে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। হ্যাঁ, তাদের শিফট থাকে, তাদের বিরতি থাকে কিন্তু সেটা অন্য যেকোনো পেশার থেকে কম। পথে ডিউটির সময় তাদের খাবার কিংবা টয়লেট ব্যবহারের সুবিধা কতটুকু রয়েছে তা নিয়ে আমাদের কি কোনো ভাবনা রয়েছে? ট্রাফিক পুলিশ কোনো গাড়িকে থামালেই আমরা অনেকেই মুখে না বললেও মনে মনে একটা গালি দিয়ে দিই, অথচ গাড়ির মালিক থেকে চালক পর্যন্ত যে বেআইনি কাজটি করছে তার প্রতি আমাদের খেয়াল হয় না।
পুলিশের সবগুলো বিভাগই দিনরাত কাজ করে যায়। ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’ বাণী নিয়ে কাজ করেও, আধুনিকায়ন এনেও, দুর্নীতির হ্রাস ঘটিয়েও জনগণের আস্থা অর্জনে যথেষ্ট হিমশিম খেতে হচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশকে। অথচ যেকোনো আইনি জটিলতা কিংবা অপরাধের সম্মুখীন হলে আমরা প্রথমেই পুলিশের শরণাপন্ন হই। সকাল কিংবা মাঝরাত যখনই প্রয়োজন হোক পুলিশই সর্ব প্রথম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। সরকারি সেবা হিসেবে ৯৯৯ নম্বরে কল করে যেকোনো মুহূর্তে পুলিশের সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে দ্রুত সময়ে। যারা পুলিশে নিয়োজিত তাদের তাই সকাল হোক কিংবা মাঝরাত, বলামাত্র দায়িত্বে নিয়োজিত হতে হয়। অথচ তাদের পরিবারের মানুষরা তাকে কাছে পায় না পর্যাপ্ত সময়ের জন্য। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এ তো ঘটা করে বলার কী আছে! তারা তো এর জন্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেন। আপনার বক্তব্য ভুল না কিন্তু তাই বলে কি একটি মানুষের সারা দিন দায়িত্ব পালন করা আর নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টায় কাজ করাকে আপনি একই রকম বিবেচনা করবেন?
কাজ এবং পারিশ্রমিকের পরও আরও কিছু বিষয় থেকে যায়। যেমনজীবনের নিরাপত্তা। পুলিশে চাকরি করলেই কোনো ব্যক্তি যে সার্বক্ষণিক নিজস্ব নিরাপত্তা পান তার কিন্তু নিশ্চয়তা নেই। যেহেতু পুলিশের কার্যক্রমই অপরাধ জগতের সঙ্গে সেহেতু যেকোনো উপায়, যেকোনো মুহূর্তে তার ওপর কিংবা তার পরিবারের ওপর আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমনকি কখনো কখনো কর্তব্যরত অবস্থাতেও তারা আক্রমণের শিকার হন। এই তো কিছুদিন আগেই মিরপুর ১০-এ ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকদের হামলায় গুরুতর আহত হন একজন পুলিশ সদস্য। সামাজিকভাবে অবজ্ঞা কিংবা এড়িয়ে চলার মতো মানসিক পীড়ন তো রয়েছেই।
সুতরাং বাংলাদেশ পুলিশকে নিয়ে আমাদের সাধারণের দৃষ্টির অন্তরালেও রয়েছে এক জগৎ। খুব ঘটা করে পুলিশের নেতিবাচক বিষয়গুলোর উপস্থাপন প্রায়ই দেখা গেলেও তাদের প্রতি ইতিবাচক ভঙ্গিতে তাকানোর প্রয়াস আমাদের কমই। খুব কম প্রতিবেদনেই পুলিশ হিসেবে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, উত্থান-পতনের চিত্র উপস্থাপিত হয়। প্রতিটি পেশাতেই রয়েছে ভালো-খারাপের সংমিশ্রণ। খারাপের সংশোধন যেমন প্রয়োজন, ভালোর প্রশংসাও তেমনি অত্যাবশ্যক।
লেখক : উপ-উপাচার্য, উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়
সৌদি আরব এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের মধ্যে প্রথম কূটনৈতিক সফর ১৯৯৯ সালে হয়। এ সময় প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন রিয়াদ সফর করেন। কৌশলগত তেল সহযোগিতা চুক্তি এ সময় স্বাক্ষরিত হয় দুই দেশের মধ্যে। ২০০০-এর দশকে চীন-সৌদি কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। ২০০৪ সালে, চীন এবং সৌদি আরব নিয়মিত রাজনৈতিক সিরিজ বৈঠক শুরু করে। ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে, বাদশাহ আবদুল্লাহ প্রথম সৌদি রাষ্ট্রপ্রধান যিনি চীন সফর করেন। চীনে থাকাকালীন বাদশাহ আবদুল্লাহ জ্বালানি সহযোগিতা সংক্রান্ত পাঁচটি বড় চুক্তি স্বাক্ষর করেন। প্রেসিডেন্ট হু তখন বলেছিলেন, দুই দেশের এই দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা নতুন শতাব্দীতে চীন ও সৌদি আরবের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার একটি নতুন অধ্যায় লিখবে। প্রেসিডেন্ট হু ইতিহাসে দ্বিতীয় বিদেশি নেতা যিনি সৌদি আরবের আইন পরিষদে ভাষণ দেওয়ার অনুমতি পান। এক সময় চীন ও সৌদি আরবের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েক বছর ধরে যোগাযোগের পর প্রথম চীন-সৌদি আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয় ওমানে ১৯৮৫ সালের নভেম্বরে। দুই দেশের সরকার ২১ জুলাই ১৯৯০ তারিখে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। আরব বসন্তের পর চীন এবং সৌদি আরবের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক সৃষ্টি হতে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে উষ্ণ হচ্ছে। ২০১৫ সালের এক জনমত জরিপে বলা হয়, ৬১.৩ শতাংশ সৌদি চীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে। সাম্প্রতিক সম্পর্ক উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য দিক হলো চীন ও সৌদি আরব জ্বালানি ও আর্থিক খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে। রিয়াদ পেইচিংয়ের সঙ্গে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ এবং আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বাদশাহ সালমান এবং ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানও ইঙ্গিত দেন যে চীন মধ্যপ্রাচ্যে তার কূটনৈতিক অবস্থান বাড়াতে পারে।
কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে দুটি ঘটনা আবারও বিশেষভাবে ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সামনে নিয়ে এসেছে চীনকে। এর একটি হলো দেশটির কয়েকটি প্রধান শহরে কঠোর লকডাউনের বিরুদ্ধে নাগরিকদের নজিরবিহীন বিক্ষোভ। এবারের বিক্ষোভকে ইউরেশিয়ার সংকট হিসেবে বর্ণনা করছেন বিশ্লেষকরা। অন্য দিকে, ৭ ডিসেম্বর চীনা নেতা শি সৌদি আরব সফর করেছেন। এর আগে বাইডেনও সৌদি সফর করে আরব সম্মেলন করেছেন। কিন্তু দুই সম্মেলনে স্বাগতিক দেশের সাড়া ও প্রস্তুতি একরকম মনে হচ্ছে না। তাহলে কি সৌদি আরব বা আরব দুনিয়ার ভূ-কৌশলগত সম্পর্কে বড় পরিবর্তন আসছে? জায়গা করে নিচ্ছে চীন ও রাশিয়া?
বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি যদি কোনোভাবে আরও কিছুর সূচনা হয়, তবে চীনের শক্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। একই সময়ে রাশিয়ার শক্তি পতনশীল হয়ে উঠেছে এবং একই সময়ে ইইউ তার একীভূত দিক সম্পর্কে আরও বেশি অনিশ্চিত। ফলে এটি হতে পারে যে, পুরো ইউরেশিয়া সংকটে রয়েছে। এর অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপেক্ষিক শক্তি নাটকীয়ভাবে বাড়ছে। লক্ষণীয় যে রাশিয়া যদি ইউক্রেনে তার অবস্থান স্থিতিশীল না করে, যদি ইইউ তার প্রয়োজন মতো সমন্বয় না করে এবং যদি চীনা বিক্ষোভগুলো প্যানে ফ্ল্যাশ করার চেয়েও বেশি কিছু হয়, তবে নতুন একটি বিশ্বের উদ্ভব হতে পারে। ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স, মুহাম্মদ বিন সালমান চীন সফর করে চীনা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় দুপক্ষ বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে সম্মত হয়। উভয় পক্ষেরই নিজস্ব দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড এবং সৌদির ভিশন ২০৩০ কৌশল বাস্তবায়নে সহযোগিতা করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স চীনে একটি পরিশোধন ও পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স স্থাপনের জন্য ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে সম্মত হন। সফরের সময় সৌদি ক্রাউন প্রিন্স সৌদি আরবের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা ভাষা শেখানোর ইচ্ছার কথা ঘোষণা করেন। এটি এখন বাস্তবায়ন হয়েছে। চীন-সৌদি বাণিজ্য ২০০০ সাল থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু ২০০৫ সালে দুই দেশের বাণিজ্য ৫৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ২০০৮ সালে, চীন-সৌদি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ছিল সাড়ে ৩২ বিলিয়ন ডলারের যা সৌদি আরবকে পশ্চিম এশিয়ায় চীনের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার করে তোলে।
২০১৯ সালের মে মাসে, চীনের সৌদি অপরিশোধিত তেলের আমদানি ৪৩ শতাংশ বেড়ে সৌদি আরবকে চীনের শীর্ষ সরবরাহকারী করে তুলেছে। সৌদি আরব এবং চীনের মধ্যে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক ১৯৮০ এর দশকে আগেই শুরু হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি এফ-১৫ ফাইটারের জন্য সৌদি আরবের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করতে অস্বীকার করলে, যুবরাজ খালিদ বিন সুলতান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কেনার জন্য চীনে যান। সৌদি আরব ১৯৮৮ সালে চীনের সঙ্গে পঞ্চাশ থেকে ষাটটি পারমাণবিক-পেলোড-সক্ষম সিএসএস-২ মধ্যপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পাওয়ার জন্য একটি চুক্তি করেন। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে, চীন তার এক হাজারেরও বেশি সামরিক উপদেষ্টাকে সৌদি ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনায় রেখেছে। মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী চীনের সহায়তায় সৌদি তার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। ২০২১ সালে, সিএনএন রিপোর্ট করেছে যে, স্যাটেলাইট ইমেজগুলো ইঙ্গিত দেয় যে সৌদি আরব, চীনা সহায়তায়, একটি অনির্ধারিত ধরনের কঠিন জ্বালানিযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে। ১৫ জানুয়ারি, ২০১২-এ, চীন এবং সৌদি আরব পারমাণবিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। যা দুই দেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করার ক্ষেত্র তৈরি করে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গবেষণা চুল্লিগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নয়নের পাশাপাশি পারমাণবিক জ্বালানি উপাদান সরবরাহের মতো ক্ষেত্রগুলোতে মনোনিবেশ করা হয়। ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে এ ধরনের চুক্তির পর এই চুক্তি সৌদি আরবের চতুর্থ পারমাণবিক চুক্তি। সৌদি আরব ও অন্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের বিষয়টি চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।
সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কৌশলগত সমঝোতা ছিল সৌদি রাজতন্ত্র বৃহত্তর পরিসরে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে। সমঝোতা অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টি সৌদি আরব নিশ্চিত করে। সৌদি জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ ও বিক্রি করা হয় মার্কিন ডলারে। যুক্তরাষ্ট্র এর বিপরীতে সৌদি রাষ্ট্র এবং রাজতন্ত্রের ক্ষমতার নিরাপত্তা বিধান করতে থাকে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান এবং জুনিয়র বুশের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই সমঝোতায় চিড় ধরে। আমেরিকান গভীর ক্ষমতা বলয়ের একটি অংশ মনে করে, নাইন ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলা ও আলকায়েদা গঠনের পেছনে সৌদি নিরাপত্তা পরিষেবার সম্পর্ক রয়েছে। এ নিয়ে টানাপড়েন শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্র নিজস্বভাবে তেল উৎপাদন বৃদ্ধি করে। শেল অয়েল দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব চাহিদা পূরণ হওয়ায় সৌদি তেল নির্ভরতা কমতে থাকে। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তা ছায়া গুটিয়ে নিতে থাকে। এর মধ্যে ২০১০-১১ সালে মধ্যপ্রাচ্যব্যাপী আরব বসন্ত শুরু হলে রাজতন্ত্র ও একনায়কতান্ত্রিক শক্তিগুলো ক্ষমতা হারানোর ব্যাপারে ভীত হয়ে পড়ে। এর পেছনে পাশ্চাত্যের সমর্থন দেখতে পায় শাসক মহল। এই অবস্থায় সৌদি আরব ও অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সামনে দুটি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়। প্রথমত, তাদের উৎপাদিত জ্বালানি তেলের বিকল্প বাজার সন্ধান। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র ও ক্ষমতার নিরাপত্তা। এই দুটি ক্ষেত্রে উপসাগরীয় দেশগুলো মাত্রা ভেদে নিজেদের অরক্ষিত দেখতে পায়। জ্বালানির ক্ষেত্রে বিশেষ দুই প্রধান অপশ্চিমা বাজারের একটি হলো চীন, আরেকটি ভারত। সৌদি আরবসহ প্রধান জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশগুলো জ্বালানির এই দুই বাজার নিশ্চিত করার জন্য চীন ও ভারত দুই দেশের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরির দিকে অগ্রসর হয়। আর নিরাপত্তা আশ্রয়ের বিষয়ে অপশ্চিমা দুই প্রধান ক্ষমতাধর দেশ হলো রাশিয়া ও চীন।
উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত কৌশলগত সম্পর্ক নির্মাণের অংশ হিসেবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ছাড়িয়ে প্রতিরক্ষা খাতের সহযোগিতার বন্ধন তৈরি করে, রাশিয়া ও চীন দুই দেশের সঙ্গে। এরই মধ্যে চীনের রাষ্ট্রপতি শি চিনপিং ৭ ডিসেম্বর সৌদি আরব সফর করেছেন। শি’র সফর এবং শীর্ষ সম্মেলন আমেরিকার বাইডেন প্রশাসনের অনুরোধের বিপরীতে ওপেক প্লাস দ্বারা প্রতিদিন তেলের উৎপাদন দুই মিলিয়ন ব্যারেল কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে রিয়াদ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করেছে। সৌদি আরব এবং প্রতিবেশী সংযুক্ত আরব আমিরাতও চীন আর রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্কের বিষয়ে পক্ষ বেছে নেওয়ার মার্কিন চাপ প্রতিহত করেছে। পেন্টাগন তার বার্ষিক চায়না ডিফেন্স পাওয়ার শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছে, যেহেতু আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের মতো অঞ্চলে পেইজিংয়ের অর্থনৈতিক স্বার্থ প্রসারিত হচ্ছে। তাই আমরা বিশ্বব্যাপী শক্তি প্রক্ষেপণ কার্যক্রম সম্প্রসারণের ওপর বর্ধিত ফোকাস দেখতে পাব। তা না হলে যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় অঞ্চলে তার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। শাসন পরিবর্তনের যে এজেন্ডা বাস্তবায়নের স্বপ্ন বাইডেনের এই অঞ্চলে রয়েছে তা মুখ থুবড়ে পড়বে। দেখার বিষয় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের গভীর ক্ষমতা বলয় চীন-রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্যে গভীরভাবে সম্পৃক্ততাকে কীভাবে দেখে।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক, যুক্তরাজ্য
সারা দেশে প্রতিদিনই সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণ ও অঙ্গহানির তথ্য উদ্বেগজনক। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনা। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ৬ হাজার ৮২৯ দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৭১৩ জন নিহত হয়েছেন। এ হিসাবে গত বছর দৈনিক গড়ে ২১.১৩ জন নিহত হয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। সড়ক দুর্ঘটনার পর অনেকেরই রাগ ক্ষোভ গিয়ে পড়ে পরিবহন শ্রমিকদের ওপর। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা ও নানা সংকটের পেছনে আসলে শ্রমিকদের দায় কতটা সে বিবেচনা যেমন জরুরি, তেমনি পরিবহন শ্রমিকরা কতটা মানবেতর জীবনযাপন করেন এবং কতভাবে অধিকার বঞ্চিত হন সেই আলোচনাও জরুরি। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ চালক ও পরিবহন শ্রমিকদের অনির্ধারিত কর্মঘণ্টা ও অসুস্থতা হলেও বিষয়টি বরাবর উপেক্ষিত। দুর্ঘটনায় কোটি কোটি টাকার গাড়িও নষ্ট হচ্ছে। তারপরও পরিবহন মালিকদের এই বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। চালকদের স্বাস্থ্যগত বিষয়ে খোঁজ রাখেন না তারা। শ্রমিক নেতারা দায় চাপান সরকার ও গাড়ির মালিকদের ওপর।
বুধবার দেশ রূপান্তরে ‘চালকের ঘুমে ছয়জন চিরঘুমে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শরীয়তপুরের জাজিরায় একটি ট্রাকের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সের সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হয়েছেন। পুলিশ বলছে, পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার কাছে গতিনিরোধক পার হতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দেয়। এ ঘটনায় নিহত অ্যাম্বুলেন্স চালকের ছোট ভাইয়ের বরাত দিয়ে পুলিশ পরিদর্শক আবু নাঈম জানিয়েছেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স চালক রবিউল গত রবিবার রাত ২টার দিকে ঢাকা থেকে রোগী নিয়ে ভোলা যান। কোনো বিরতি না দিয়ে সোমবার রাতেই ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন এবং মঙ্গলবার ভোর ৪টা ২০ মিনিটে এ দুর্ঘটনা ঘটে।’ হিসাব করলে দেখা যায়, ২৬ ঘণ্টারও বেশি সময় তিনি কোনো বিরতি না দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চালিয়েছিলেন। অবস্থাদৃষ্টে বোঝাই যাচ্ছে যে বিরতিহীনভাবে দীর্ঘ সময় অ্যাম্বুলেন্স চালানোর কারণে নির্ঘুম চালক দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে যাত্রীসমেত চিরঘুমে চলে গিয়েছেন। কবির মতো আক্ষেপ করে বলা যেতে পারে ‘কোনোদিন জাগিবে না আর।’ দুর্ঘটনায় ৬ জনের প্রাণহানি যেমন মানা যায় না, তেমনি একজন মানুষ টানা ২৬ ঘণ্টা ঘুমহীন অ্যাম্বুলেন্স চালিয়ে যাচ্ছেন এ ঘটনাটিও আমাদের পরিবহন ব্যবসার ভয়াবহ ত্রুটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
এর আগে, গত বছর বিআরটিএ ও ঢাকা আহছানিয়া মিশনের উদ্যোগে চালানো সমীক্ষায় জানা যায়, দেশের পরিবহন-চালকদের ৩৯.৩৩ ভাগই রক্তে মাত্রাতিরিক্ত সুগার ও উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন। চিকিৎসকরা বলেছেন, ‘কারও রক্তে সুগার মাত্রাতিরিক্ত কমে গেলে সেই ব্যক্তি হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারেন। রক্তচাপের সমস্যা থাকলে মাথা ঘুরতে পারে ও দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। রক্তচাপ খুব বেশি হলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ পর্যন্ত হতে পারে।’ আশঙ্কার কথা হচ্ছে, শারীরিক জটিলতার কথা এসব চালক পরীক্ষার আগে জানতেনই না। তারা না জেনেই গাড়ি চালাচ্ছেন। চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের শরীরে জটিলতা দেখা দিলে বিশেষ করে ঘাড়-মাথাব্যথা করলে তাদের ঘুম ভালো হয় না। গাড়ি চালানো অবস্থায় তাদের অনেকের ঝিম ধরে। অনেক চালক গাড়ি চালানো অবস্থায় ক্লান্ত হয়ে দুর্ঘটনায়ও পড়েছেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব বলেছিলেন, ‘চালকদের শরীর গাড়ি চালানোর উপযোগী আছে কিনা তা দেখার কোনো সিস্টেম নেই। বিষয়টি দেখে বিআরটিএ ও শ্রমিক ফেডারেশন।’ অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় চালকদের দায়ী করা হলেও তাতে মাদকাসক্তিকেই কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিআরটিএও চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার সময় ডোপটেস্ট নিয়েই দায় সারে। জাতীয় সড়ক পরিবহন মোটর শ্রমিক ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, ‘শ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা সরকার বা গাড়ির মালিকরা কখনো করেনি।’ অন্যদিকে, বাসচালক-শ্রমিকদের প্রায় কারোই নির্দিষ্ট বেতনভাতা নেই, নেই নিয়োগপত্র কিংবা চাকরির অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা। বেতন না থাকায় মালিকের বেঁধে দেওয়া আয়ের লক্ষ্য পূরণে দৈনিক প্রায় ১৮-২০ ঘণ্টার বিশ্রামহীন কাজের চাপ, শরীর চাঙ্গা রাখতে মাদকে জড়ানো, নিম্ন মজুরি, কাজের অনিশ্চয়তা, মালিক-যাত্রী-প্রশাসনের লাঞ্ছনা, অর্থকষ্ট, অনিশ্চিত জীবন, শেষ জীবনে দুর্গতি, পারিবারিক অশান্তিসহ এক টালমাটাল জীবন পার করে থাকে দেশের কয়েক লাখ পরিবহন শ্রমিক। পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন সড়কের নৈরাজ্য আর বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে পরিবহন শ্রমিকদের এই মানবেতর অনিশ্চিত জীবনের বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে।
নাট্যকার ও অভিনেতা বিজন ভট্টাচার্য ১৯০৬ সালের ১৭ জুলাই রাজবাড়ী জেলার খানখানাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ক্ষীরোদবিহারী ভট্টাচার্য ছিলেন স্কুলশিক্ষক। কিশোর বয়সেই অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি কারাবরণ করেন। পরে কলকাতার আশুতোষ কলেজ ও রিপন কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৩১ সালে জাতীয় আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি মহিষবাথানে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। ফলে বিএ পড়ার সময়ই লেখাপড়ায় ইতি ঘটে। ১৯৩২ সালে বিজন কিছুদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে তিনি মাতুল সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের ‘অরণি’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন এবং বিভিন্ন বিষয়ে লিখতে শুরু করেন। ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। নবনাট্য আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক বিজন গণমানুষের সংগ্রাম, বঞ্চনা নিয়ে নাটক রচনা করেন। তার প্রথম নাটক ‘আগুন’ (১৯৪৩)। তার প্রতিভার সার্থকতম নিদর্শন ‘নবান্ন’। তার উল্লেখযোগ্য দুটি গল্প তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত ‘জনপদ’ এবং দেশভাগের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘রাণী পালঙ্ক’। তিনি মুম্বাইয়ে চলচ্চিত্রে অভিনয় ও ফিল্ম স্ক্রিপ্ট লেখার কাজও করেন। নাটকশিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য কেন্দ্রীয় সংগীত নাটক আকাদেমি, পশ্চিমবঙ্গ সংগীত নাটক আকাদেমি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পুরস্কৃত করে। ১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারি কলকাতায় তিনি মারা যান।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
আর কখনো রাজনীতিতে জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মুচলেকা দিয়ে এ কথা বলেছে তারা। সংগঠনটির নেতারা আরও বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের অংশও হবেন না তারা। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপন কোনো সম্পর্কেই জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম।
হেফাজতে ইসলাম বেশ কিছু শর্তও দিয়েছে। শর্তে তারা বলেছে, হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ যেসব নেতা কারাবন্দি রয়েছেন তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে এবং মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলাম গত বছর ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে এ মুচলেকা দেয় এবং এসব শর্ত বা দাবি জানায়।
আগে হেফাজত নেতারা তিন মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তারপর দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মুচলেকা দেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হেফাজতের মুচলেকা দেওয়ার কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। সরকারের সহযোগী হিসেবে থাকার অঙ্গীকার করেছে হেফাজত।
১৪ দলের অন্যতম শরিক তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভা-ারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়; তারা রাজনীতি করবে না। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধও হবে না।
হেফাজতে ইসলাম আরও কিছু শর্ত দিয়েছে, যেমন কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর বৃহত্তম বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশকে (বেফাক) সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার ও তাদের মুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে মামুনুল হক এবং আরও কয়েকজনকে এখনই মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে সরকারি মহল। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মামুনুলকে ছাড়তে হবে, যা সময়সাপেক্ষ।
সূত্রে আরও জানা গেছে, কাদিয়ানি সম্প্রদায় বিষয়ে হেফাজতের দাবি আপাতত আমলে নেওয়া হয়নি। কারণ, তাদের অমুসলিম ঘোষণা করা হলে বিদেশি চাপ আসবে। যে চাপ সামলানো প্রায় অসম্ভব। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ঝামেলায় জড়ানো যাবে না বলে হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে। বেফাক ইস্যুতেও আপাতত কোনো উদ্যোগ নিতে চায় না সরকার। বেফাককে সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মানাও আপাতত অসম্ভব, জানিয়েছে সরকার। তবে হেফাজত নেতাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, অন্য শর্তগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।
হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে, ধর্মীয় বিভিন্ন অপপ্রচার চলছে সরকারের বিরুদ্ধে; এসব ব্যাপারে কথা বলতে হবে তাদের। জামায়াতবিরোধী অবস্থান নিয়ে কাজ করতে হবে হেফাজতকে। হেফাজত নেতারা বলেছেন, জামায়াত ইস্যুতে তারা কোনো ছাড় দেবে না। জামায়াতকে তারা ইসলামের ধারক-বাহক মনে করে না।
বলা যায়, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক বোঝাপড়া হয়েছে। এটা একটা ‘পলিটিক্যাল ডিল অর আন্ডারস্ট্যান্ডিং’। জানা গেছে, এ সমঝোতার ভিত্তিতেই হেফাজতের বিরুদ্ধে ২০৩টি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে এবং নেতারা জামিন পেতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে পুলিশকে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে। হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার।
২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় এখনো তদন্ত হচ্ছে ২০৩টি মামলার। অনেক দিন ধরেই তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু সুরাহা করতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থাগুলো। হেফাজত নেতাকর্মীদের অনেকে কারাগারেও আছেন। তবে বেশিরভাগ আসামি প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন।
পুলিশের পাশাপাশি হেফাজত নেতারা মামলাগুলো নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা এগুলোর নিষ্পত্তি চান। এ নিয়ে কয়েক দফা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজত নেতারা। সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হয়েছে। বৈঠকে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীও তাদের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা পেয়ে পুলিশও কাজ শুরু করে দিয়েছে। গত এক মাসে অন্তত ১০ জন নেতা জামিন পেয়েছেন। তারা যেকোনো সময় কারামুক্ত হবেন। তবে মামুনুল হক আপাতত মুক্ত হচ্ছেন না।
হেফাজত নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তারা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন। তারা বলেন, এসবের জন্যই সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়েছি আমরা। তবে সমঝোতার কথা সবিস্তারে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে মৌখিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। হেফাজত নেতারা সরকারের অঙ্গীকার করেছে, তারা রাজনৈতিক কর্মকা- চালাবেন না। শুধু ইসলাম নিয়ে কথা বলবেন। জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা-ের সমালেচনাও করবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশ্বস্ত করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন তদন্তকারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা এসেছে। আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। মামলাগুলোর অনেক আসামি জামিনে আছে, কেউ কেউ জামিন ছাড়াই প্রকাশ্যে ঘুরছে। দীর্ঘদিন ধরে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়ায় সমালোচনাও হচ্ছে সবখানে। এগুলোর দ্রুত সুরাহা চাচ্ছি আমরাও।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ করে তারা। একপর্যায়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। সে সময় হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। তারা রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে যানবাহন ভাঙচুর করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সহিংসতায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
২০২১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরের বিরোধিতা করে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় তাদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয় এবং পুলিশসহ সহস্রাধিক হেফাজত নেতাকর্মী আহত হয়। হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায়। এসব ঘটনায় সারা দেশে ১৫৪টি মামলা হয়। ওইসব মামলার কোনোটাতেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
হেফাজত ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সবাই ছিলেন। বৈঠকে আমরা বলেছি, আমরা কোনো ধরনের রাজনীতি করি না। ইসলাম নিয়ে কাজ করি। একটি মহল আমাদের নামে অপবাদ দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, আমরা রাজনীতি করছি না, আর করবও না।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। আমরাও চাচ্ছি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। হেফাজতের কেন্দ্রীয় এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমরা গত ১৭ ডিসেম্বর বৈঠক করেছি। তাতে সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট বৈঠক হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। আমাদের শর্তও তাকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সমঝোতা ছাড়া কোনো কিছুরই সমাধান হয় না। আমরা চাই না সরকারের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হোক। আমরা কথা বলেছি। সরকারপ্রধান ইতিবাচক হিসেবে বিষয়টি আমলে নিয়েছেন।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
নাগরিকত্ব বিষয়ক জটিলতার জেরে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে দেশের উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ ও পার্লামেন্টে আসন হারিয়েছেন নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী রবি লামিছানে। শুক্রবারের রায়ে আদালত জানিয়েছে, এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকত্বও নেই তার।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র বিমল পৌদেল বার্তা সংস্থা এএফপিকে এ সম্পর্কে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় অনুযায়ী, ২০২২ সালের জাতীয় নির্বাচনে নাগরিকত্ব বিষয়ক আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে রবি লামিছানের বিরুদ্ধে। এ কারণে এখন থেকে আর পার্লামেন্টের সদস্য নন তিনি।’
নেপালের এক সময়ের জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব রবি লামিছানে দেশটির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ইনডিপেনডেন্ট পার্টির শীর্ষ নেতা। ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর নেপালের পার্লামেন্ট প্রতিনিধিসভার নির্বাচনে তার দল ২০টি আসনে জয়ী হয়েছে। তারপর গত ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন জোট সরকারে নিজের দলসহ যোগ দিয়ে নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন লামিছান।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিত্ব ছিল লামিছানের; কিন্তু নেপালের সংবিধানে দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বীকৃত না হওয়ায় ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। শুক্রবারের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, নিয়ম অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর নেপালের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার কথা ছিল লামিছানের; কিন্তু তা করেননি তিনি। ফলে এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকও নন লামিছান। এদিকে, শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর লামিছানের প্রতিক্রিয়া জানতে তার মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে গিয়েছিলেন সাংবাদিকরা; কিন্তু লামিছানে তাদের বলেন, ‘যেহেতু এই মুহূর্তে আমি কোনো দেশেরই নাগরিক নই, তাই আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করা আমার পক্ষে উচিত নয়, সম্ভবও নয়।’