বর্ষায় চারদিকে পানি থইথই। নেই শুধু খাবার পানি। খরায় সব শুকিয়ে চৌচির। মেলে না খাবার পানি। কারণ পর্যাপ্ত পরিমাণ নলকূপ নেই। যে সব নলকূপ আছে তা বর্ষায় ডুবে যায়, খরায় নেমে যায় পানির স্তর। ফলে বেশ খানিকটা পথ পাড়ি দিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে সেই পানি সংগ্রহ করতে হয়। আর এই কাজটা বেশিরভাগই করতে হয় নারীদের। পানি সংগ্রহের কষ্ট বা অল্প পানির কারণে তারা প্রযোজনের তুলনায় পানি পান করেন কম। আর এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ নানা রকম সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের।
পানি নিয়ে এমন অবর্ণনীয় কষ্ট করছেন গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নের ১৮টি গ্রামের প্রায় ২৬ হাজার মানুষ। যাদের সুপেয় পানির সন্ধানে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে। সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে এই দুর্ভোগের চিত্র দেখা গেছে। গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে গড়ে ওঠা চর এটি। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কিংবা ব্যক্তিগত বাহনে ফজলুপুর খেয়াঘাট পর্যন্ত যাওয়া যায়। সেখান থেকে কিছু অংশ নৌকায় কিছু অংশ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হয় ৭ থেকে ৮ কিলোমিটার পথ।
যাত্রাপথের নানা ঝক্কিঝামেলা কাটিয়ে ফজলুপুর চরে পৌঁছে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে। তাদেরই একজন জাহানারা বেগম। তিনি জানান, চরে সমস্যার শেষ নেই। বড় সমস্যা হলো পানি। কাছাকাছি পানির উৎস নেই। পানির কষ্ট ১২ মাসই পোহাতে হয়। তবে শুষ্ক মৌসুম ও বন্যার সময় এ দুর্ভোগ আরও বাড়ে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই কষ্ট নারীদেরই বেশি। কারণ পানি আনা-নেওয়ার কাজটি বেশিরভাগ সময় তারাই করে থাকেন। যদিও আগের চেয়ে পুরুষরাও এখন কিছুটা সহযোগিতা করছেন। অনেক সময় পানি আনতে একটু দেরি হলে স্বামীরা বকাঝকা করেন এমন অভিযোগ কোনো কোনো নারীর।
সোনাভান নামে এক গৃহবধূ বলেন, কার্তিক থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ টিউবওয়েলে ঠিকমতো পানি ওঠে না। আর বর্ষায় বেশিরভাগ টিউবওয়েল তলিয়ে যায় পানিতে। তখন বিপাকে পড়তে হয় বিশুদ্ধ খাবার পানি নিয়ে। ময়লা পানি দিয়ে থালাবাসন ধুতে হয়।
সুপেয় পানির পাশাপাশি সেখানে রয়েছে ফসলে সেচের পানিরও অভাব। সেই সমস্যার কথা তুলে ধরে মো. মাসুদ রানা বাবু মন্ডল জানান, খরার কারণে ফসলের আবাদ ঠিকমতো করা যায় না। শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে বারবার সেচ দিতে গিয়ে ব্যয় বেড়ে যায় অনেক।
স্বাস্থ্যঝুঁকি : বর্ষায় খাবার পানির সংকট আর শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ৮০ শতাংশ টিউবওয়েলে পানি ওঠে না বলে জানালেন গ্রামটির বাসিন্দারা। পানির সংকটে অনেকেই, বিশেষ করে নারীরা চাহিদার তুলনায় কম পানি পান করেন। এতে শারীরিক নানা সমস্যা দেখা দেয়। ফলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি পড়েন তারা।
স্বাস্থ্যগত সমস্যার কথা তুলে ধরে সেখানকার বাসিন্দারা জানান, পানির অভাবে নারীদের জরায়ুর সমস্যা হচ্ছে। নারীদের মাসিকের সময় পানি নিয়ে আরেক সংকটে পড়তে হয়। আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে নারীরা স্যানেটারি ন্যাপকিন ব্যবহার না করে পুরনো কাপড় ব্যবহার করেন। পানির অভাবে ঠিকমতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পারেন না। একই কাপড় বারবার ব্যবহারে নারীদের নানারকম শারীরিক সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে।
স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক শাহিন আলম জানান, প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি দরকার তা চরের বেশিরভাগই পান করেন না। এতে শরীরে পানিশূন্যতাসহ নানা সমস্যা তৈরি হয়। আবার বর্ষায় সুপেয় পানির অভাবে ডায়রিয়াসহ নানা রোগব্যাধি হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের কার্যকরী সভাপতি ডা. লেলিন চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, চাহিদার তুলনায় কম পানি পানে কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস, মূত্রতন্ত্রে সংক্রমণসহ নানা ব্যাধি হতে পারে। এ ধরনের শারীরিক সমস্যায় নারীদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তাছাড়া মাসিকের সময় নারীরা নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না থাকলে প্রজননতন্ত্রে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
‘অন্যদিকে বিশুদ্ধ পানি পান না করলে ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস-বি, টাইফয়েডসহ দেখা দিতে পারে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা। এমনকি এটি মানুষের মৃত্যুর কারণও হতে পারে। তাছাড়া দূষিত পানি দিয়ে গোসল করলে শরীরে চর্মরোগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে’যোগ করেন তিনি।
চরের বাসিন্দাদের নিরাপদ ও চাহিদামতো পানি সরবরাহের জন্য সরকারকে আহ্বান জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, স্থানীয় সরকারকে যুক্ত করে সেখানকার বাসিন্দা ও স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পানির এই সংকট দূর করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ওই এলাকার নদীর পানি এনে তা খাবার উপযোগী করে সরবরাহ করা, বৃষ্টি কিংবা নদীর পানি সংরক্ষণের পাশাপাশি চাহিদামতো নলকূপ সরবরাহ করা দরকার।
সময় ব্যয়, নিরাপত্তা ঝুঁকি, দুর্ঘটনা : চরের বাসিন্দা জেলেখা জানান, খাবার পানি নিতে গিয়ে অনেক সময় লাইন লেগে যায়। প্রতিদিন বেশ কয়েকবার পানি আনতে গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করতে হয় নারীদের।
গৃহবধূ শ্যামলায় বেগম জানান, শিশুদের ঘরে রেখে পানি আনতে যাওয়ায় নানা রকম দুর্ঘটনার ভয় হয়। শিশুরা অনেক সময় কান্নাকাটি করে। পানি আনতে গিয়ে ঘরে আগুন লেগে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সন্ধ্যার পর কিংবা রাতে পানি আনতে যাওয়া আরেক বিপদ।
এসব সমস্যার পাশাপাশি নারীদের নিরাপত্তাহীনতা, তাদের বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিসহ আরও সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় বলে জানালেন বাসিন্দারা।
সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ: চরে পানি সংকট সমাধানে এগিয়ে এসেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসকেএস ফাউন্ডেশন। তাদের ক্রিয়া প্রকল্পের আওতায় ঝুঁকি হ্রাস ও অভিযোজন পরিকল্পনার মাধ্যমে চাহিদা নিরূপণ করে কমিউনিটিভিত্তিক ১৫-২০টি পরিবারের জন্য একটি করে টিউবওয়েল দেওয়া হয়েছে ফজলুপুর ইউনিয়নে। সবমিলে এখন পর্যন্ত ১০টি টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে। আরও ৭টি টিউবওয়েল স্থাপনের কাজ চলছে। একইভাবে পার্শ্ববর্তী ফুলছড়ি ইউনিয়নেও চলছে এই কার্যক্রম।
এসব তথ্য জানিয়ে এসকেএস ফাউন্ডেশনের ক্রিয়া প্রকল্পের সমন্বয়কারী লাবলী খাতুন জানান, বন্যার পানিতে যাতে তলিয়ে না যায় সেজন্য ‘ফ্লাড লেভেল’ থেকে অন্তত ২ ফুট উঁচু করে বসানো এসব টিউবওয়েলের চারপাশ ইট-বালি-সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে দেওয়া হয়েছে। বৃদ্ধ এবং প্রতিবন্ধীদের কথা বিবেচনা করে আর্সেনিকমুক্ত টিউবওয়েলগুলোতে রাখা হয়েছে নিরাপদ র্যাম্পের (সিঁড়ি) ব্যবস্থা।
তিনি বলেন, ‘এর বাইরে ঝুঁকি হ্রাস ও অভিযোজন পরিকল্পনার আওতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে পুরো ইউনিয়নে ২৫টি টিউবওয়েল দেওয়া হয়েছে। এ জন্য গ্রামভিত্তিক তালিকা তৈরি, পরিকল্পনা প্রণয়ন, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনসহ এটি বাস্তবায়নের সব ধরনের সহযোগিতা করেছে এসকেএস ফাউন্ডেশন।’
তবে অপর্যাপ্ত বরাদ্দের কারণে ইউনিয়ন পরিষদের এসব টিউবওয়েল স্থাপন, বোরিং এবং অন্যান্য কাজ চরের বাসিন্দাদেরই করতে হয়। এমনকি কিছু পাইপ কেনার ব্যয়ও তাদের বহন করতে হয় বলে জানালেন সেখানকার বাসিন্দারা।
চরটিতে এমন দুর্দশার চিত্র দেখে ফেরার পথে পড়ন্ত বিকেলে নৌকায় বসে কথা হয় ফজলুপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আনছার আলী মÐলের সঙ্গে। পানি সংকটের কথা স্বীকার করে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে পুরো ইউনিয়নে মাত্র ৩৬টি টিউবওয়েল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি গ্রামে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫টি টিউবওয়েল দরকার। পুরনো কিছু টিউবওয়েল অকেজো আছে। কতগুলোতে ঠিকমতো পানি উঠছে না। আমরা ইউএনওকে জানিয়েছি বিভিন্ন সময়। মাসিক সমন্বয় সভায় কথা হয়। তারা বলেন, টিউবওয়েল এলে দেব।’
গাইবান্ধা জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সায়হান আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রতিটি ইউনিয়নে ২৬টি টিউবওয়েল বরাদ্দ দেওয়া হতো। সেখান থেকে কমে এখন ১২টিতে এসেছে।
জানতে চাইলে ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘টিউবওয়েল এলে সেগুলো সময়মতো বিতরণ করা হয়। যেহেতু আপনি ফজলুপুরে পানির সমস্যার কথা বললেন, এখন আমরাও টিউবওয়েলের বরাদ্দ আরও কীভাবে বাড়ানো যায় সেই চেষ্টা করব।’
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. আহসানুল ওয়াহেদ জানান, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় চরটিতে আগে যেখানে ৪০-৫০ ফুট নিচেই পানি পাওয়া যেত, এখন পানি পেতে ৬০-৭০ ফুট পর্যন্ত বোরিং করতে হয়। এটা একটা বড় সমস্যা। সমাধান হিসেবে ভূ-গর্ভস্থ পানির পাশাপাশি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার করা দরকার।
পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, কম পানি লাগে এমন ফসল যেমন ভুট্টা, বাদাম ইত্যাদি চাষ করা হলেও ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমবে।
আহসানুল ওয়াহেদ আরও বলেন, বন্যার সময় চরের বাসিন্দারা নিরাপত্তাহীনতা, সুপেয় পানির অভাবসহ সব মিলে চরম অসহায় হয়ে পড়েন। এসব সমস্যার কথা বিবেচনা করে সরকারকে স্থানীয়ভাবে পরিকল্পনা করতে হবে। প্রতিটি ইউনিয়নের যেসব সংকট আছে সেগুলো ধরে পরিকল্পনা করে সে অনুযায়ী বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি তা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মধ্য দিয়ে যথাযথ বাস্তবায়ন হলে চরের বাসিন্দাদের জীবনমানের উন্নতি হবে।
এ জন্য সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
শিক্ষার্থী ঝরেপড়া ও অন্যান্য সমস্যা : এখানকার শিক্ষার সুযোগও অনেক কম। পুরো ইউনিয়নে একটি মাত্র উচ্চবিদ্যালয় এবং ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে বলে জানান সেখানকার বাসিন্দারা।
তাদের ভাষায়, বর্ষায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ডুবে যাওয়া এবং যাতায়াত সমস্যার কারণে স্কুলে যেতে পারে না শিক্ষার্থীরা। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব দেখা দেয়। কিশোরীদেরও পানি আনার কাজ করতে হয়। স্কুলেও পানির সমস্যা দেখা দেয়। কিশোরীরা মাসিক চলাকালে স্কুলে যায় না। ফলে শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়ার হার বাড়ছে।
শাহীতন নামে এক গৃহবধূ জানান, বন্যার সময় ফসল ক্ষেত তলিয়ে যায়। মানুষের আয়-রোজগারও তেমন একটা থাকে না। কোনো আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় একঘরের মধ্যে অথবা টিনের চালের ওপর উঠে পরিবারের সবাইকে দিন কাটাতে হয় অনাহারে-অর্ধাহারে। শিশুদের নিয়ে সমস্যা হয়। বিশেষ করে পানিতে ডুবে যাওয়ার ভয় থাকে। আর গর্ভবতী নারী ও কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েন এই সময়ে।