সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজ ও পরিবারের ছয় সদস্যের নামে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল আবাসিক প্রকল্পে ৬০ কাঠার প্লট নেওয়ার অভিযোগে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই মামলার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা শুধু নিজে ও তার পরিবারের নামে প্লট বরাদ্দ নেননি। তিনি তার মন্ত্রিসভার সদস্য, এমপি, সচিব, সরকারি কর্মচারী ও দলীয় নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রায় ৮৫০ মানুষকে প্লট বরাদ্দ দিয়েছেন। দুদক তাদের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে সাবেক নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব হেলালুদ্দীন আহমদসহ ৩২ জনের প্লট বরাদ্দের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে। দুদক ও রাজউক থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
দুদকের তথ্য বলছে, সাবেক সচিব হেলালুদ্দীনসহ ৩২ জন প্রভাবশালীর অভিযোগ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের পর সংস্থাটির উপপরিচালক মো. মনিরুল হককে প্রধান করে সাত সদস্যের টিম গঠন করা হয়েছে। টিমের প্রধান অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তথ্য চেয়ে গত ১৩ এপ্রিল রাজউক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়, হেলালুদ্দীন আহমদকে বিধিবিধান লঙ্ঘন করে রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পে সাড়ে সাত কাঠা জমি বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান আছে। তার রাজউকের কোনো প্রকল্পে প্লট-ফ্ল্যাট বরাদ্দ প্রদান করা হয়ে থাকলে তার আবেদন থেকে চূড়ান্ত বরাদ্দ পর্যন্ত নোটাংশসহ রেকর্ডপত্র, রাজউকের প্লট বরাদ্দের নীতিমালা, বোর্ডসভার অনুমোদন ও রেজল্যুশন, বোর্ডসভার নোটশিটের সত্যয়িত কপি চাওয়া হয়।
অন্য এক চিঠিতে হেলালুদ্দীন আহমদের অনুসন্ধান নথির সঙ্গে সম্পৃক্ত সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য (এমপি) ও সচিবসহ ৩১ জনের নামে রাজউকের কোনো প্রকল্পে প্লট-ফ্ল্যাট বরাদ্দ প্রদান করা হয়ে থাকলে তার আবেদন থেকে চূড়ান্ত বরাদ্দ পর্যন্ত নোটাংশসহ রেকর্ডপত্র, রাজউকের প্লট বরাদ্দের নীতিমালা, বোর্ডসভার অনুমোদন ও রেজল্যুশন, বোর্ডসভার নোটশিটের সত্যয়িত কপি ১৫ এপ্রিলের মধ্যে দুদকে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হলো।
যাদের রেকর্ডপত্র চাওয়া হয় তারা হলেন- সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, খাদ্য প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, বাণিজ্যমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, রেলমন্ত্রী মজিবুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপন, শিল্পপতি কামাল আহমেদ মজুমদার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম, মজিবুর রহমান, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য, মৎস্য প্রতিমন্ত্রী আব্দুল হাই, ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক হাসান সিদ্দিকীর রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়েছে।
তথ্য বলছে, দুদকের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার রাজউক থেকে রেকর্ডপত্র দুদকে পাঠানো হয়েছে। দুদক এসব রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা শেষে অনুসন্ধান টিম কমিশনে একটি প্রতিবেদন দাখিল করবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, সাবেক সচিব হেলালুদ্দীনসহ কয়েকজনের নামে বিধিবিধান না মেনে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান আছে। অনুসন্ধান শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।
দুদকের একজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে বিশেষ কোটায় মন্ত্রী, এমপি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ বিপুলসংখ্যক মানুষকে প্লট বরাদ্দ দিয়েছে। এসব প্লট বিধিবিধান মেনে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। সাবেক সচিব হেলালুদ্দীনসহ কয়েকজন নামে বিধিবিধান না মেনে প্লট দেওয়ার অভিযোগের অনুসন্ধানের প্রয়োজনের রাজউকের কাছে রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়েছে। এসব রেকর্ডপত্র দুদকে এসে পৌঁছেছে। রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা শেষে অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে। এরপরই অনুসন্ধান টিম তাদের প্রতিবেদন দাখিল করবে। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুদকের কাছে থাকা অভিযোগে বলা হয়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার বিগত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সরকারি চাকরি, জনসেবা কাজে ‘অসামান্য অবদানের’ কথা বলে নিজেদের ঘনিষ্ঠদের রাজউকের প্লট বরাদ্দ দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি তা বরাদ্দ পেয়েছেন বিগত তিন সংসদের সাবেক সংসদ সদস্যরা। তাদের মধ্যে মন্ত্রী-এমপি ও সচিবসহ ৩০০ জনকে প্লট দিয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, বিচারপতি, প্রবাসী, আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যক্তিগত সহকারী এবং গাড়িচালকসহ আরও ৫৫০ জনকে প্লট বরাদ্দ দিয়েছে। তারা মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের অনুগত হিসেবে প্লট পেয়েছেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, রাজউক পূর্বাচল নতুন শহর, উত্তরা তৃতীয় প্রকল্প এবং ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পের তাদের প্লট দেওয়া হয়। তারা প্রতি কাঠা প্লটের জন্য পরিশোধ করেছেন ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। বর্তমানে এসব প্রকল্পে প্রতি কাঠা প্লটের দাম ৫০ লাখ থেকে কোটি টাকার বেশি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিশেষ কোটা মূলত নিজেদের অনুগত লোকজনকে সুবিধা দিতে তৈরি করা হয়েছিল। এ কোটা ব্যবহার করে তারা হাজার হাজার কোটি টাকার প্লট হাতিয়ে নিয়েছেন।
এদিকে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের মাধ্যমে রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ৬০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্য মিলিয়ে সাতজনের বিরুদ্ধে চলতি বছর ১২ ও ১৩ জানুয়ারি করা ছয়টি মামলা করে দুদক। মামলার তদন্ত শেষে গত ১০ মার্চ অভিযোগপত্র অনুমোদন দেয় দুদক। ওই সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। পরদিন চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়।
ছয়টি মামলার আসামিরা হলেনÑ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ (পুতুল), বোন শেখ রেহানা, ভাগ্নি ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিক ও ভাগ্নে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক। মামলায় শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বাইরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী, গণপূর্ত সচিব, অতিরিক্ত সচিব, রাজউক চেয়ারম্যান ও রাজউকের বোর্ড মেম্বারসহ অন্যদের আসামি করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, রাজউক প্লট বরাদ্দ দেয় সংস্থাটির অ্যালটমেন্ট অব ল্যান্ডস রুলস ১৯৬৯ অনুসারে। এই বিধিমালায় রাজউক কোনো আবাসিক প্রকল্প নিলে প্লট বরাদ্দের জন্য গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন আহ্বান করে। পরে আবেদন যাচাই-বাছাই করে যোগ্যদের প্লট বরাদ্দ দেয়। তবে বিধিমালাটি ১৯৮৬ সালে সংশোধন করে নতুন একটি উপবিধি (১৩এ) যুক্ত করা হয়, যা সংরক্ষিত কোটা নামে পরিচিত। এ কোটার মাধ্যমে মন্ত্রী, এমপি, সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীর নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এরপর ২০০৯ সালে ৫ আগস্ট ১৩এ ধারাটি আবার সংশোধন করে ১৩এ (১)এ, (১বি) এবং (১সি) যুক্ত করে নতুন গেজেট প্রকাশ করা হয়। তাতে ১৩এ (১)এ উপধারায় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের, ১৩এ (১বি) উপধারায় সংসদ সদস্য এবং ১৩এ (১সি) উপধারায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্লট বরাদ্দ দেওয়ার বিধান রাখা হয়।
বিধিমালায় বলা হয়েছে, কেউ সরকারি চাকরিতে অবদান, জনসেবা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলে তারা বিশেষ কোটায় প্লট পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তবে সে ক্ষেত্রে প্লট বরাদ্দ পেতে আগ্রহীকে প্রধানমন্ত্রী কিংবা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করতে হয়। ওই আবেদন অনুমোদন পেলে সেটি রাজউকের বোর্ডসভায় বা সাধারণ সভায় উত্থাপন করতে হয়। বোর্ডসভায় প্লট বরাদ্দের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। প্লট বরাদ্দ দেওয়াসংক্রান্ত রাজউকের নথিতে ‘অবদান’ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য থাকে না। মূলত এ বিধিমালা সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী মন্ত্রী, এমপি ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে প্লট বরাদ্দ দিয়েছে।